অচেনা প্রেম – নুশরাত জাহান মিষ্টি

অচেনা প্রেম

সূচনা পর্ব

এই অন্ধকার কারাগারে ২৫ বছর পর তোমার সাথে দেখা করতে কেউ একজন এসেছে। তুমি শুনে খুশি হওনি”?

উপরোক্ত বাক্যটি জেলার সাহেব রিয়াদের উদ্দেশ্য বললেন। বাক্যটি শুনে রিয়াদের মাঝে কোন ভাবান্তর দেখা গেলো না। পঁচিশ বছর পর তার সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে, এটা শুনে তার খুশি হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু রিয়াদের মুখশ্রীতে খুশির আবেশ দেখা গেলো না। রিয়াদকে চুপ করে থাকতে দেখে জেলার সাহেব বললেন,

_” তুমি কি তার সাথে দেখা করতে ইচ্ছুক নও? সে কিন্তু তোমার দেখা পাওয়ার জন্য ব্যকুল”।

নিরবতা ভেঙে রিয়াদ বললো,

_” কে সে”?

_ ” আমি তাকে পাঠাচ্ছি এখানে, তুমি নিজেই দেখে নেও। সে কিন্তু উপর মহল থেকে অনেকটা সময় নিয়ে এসেছে”।

রিয়াদ মনেমনে বেশ চিন্তিত। তার সাথে দেখা করার জন্য কে আসতে পারে! তার তো কোন পরিচিত মানুষ নেই! এতগুলো বছর পর কার তার সাথে দেখা করার ইচ্ছে হলো!

রিয়াদের এক মন বলছে,

_” হয়তো সে অন্যকারো সাথে দেখা করতে এসেছে, ভুলে তার নাম নিয়েছে”।

হতেই পারে নামটা তার সাথে মিলে গিয়েছে! রিয়াদের ভাবনার মাঝেই তার সামনে একটি মেয়ে এসে দাঁড়ালো। রিয়াদ মেয়েটির মুখশ্রীতে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটিও কয়েক মূহুর্ত রিয়াদের মুখশ্রীতে তাকিয়ে ছিলো। পরক্ষনেই মেয়েটি বলে উঠলো,

_ ” আমি আপনার সাথে একটু আলাদা কথা বলতে চাচ্ছি”।

মেয়েটির কথার মূলভাব বুঝতে পেরে জেলার সাহেব সবাইকে চলে যেতে ইশারা করে, নিজেও চলে গেলেন। রিয়াদ এবং মেয়েটি একে-অপরের মুখশ্রীতে তাকিয়ে রইলো। দু’জনেই নিরব। নিরবতা ভেঙে মেয়েটি বললো,

_” আমি রিয়ানা জাহান। আমার মায়ের নাম রাবেয়া সুলতানা”।

রিয়াদ অস্পষ্টসুরে বললো,

_” রাবেয়া সুলতানা”?

_ আপনার চেনার সুবিধার্থে “নদী”। আসা করি আপনার চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না”।

রিয়াদ চমকে মেয়েটির অর্থাৎ রিয়ানার মুখশ্রীতে তাকালো। রিয়াদের তাকিয়ে থাকাকে উপেক্ষা করে রিয়ানা বললো,

_” আপনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন, আমি এখানে কেন এসেছি? আপনি ভাবতেও পারবেন না আপনার মুখোমুখি হওয়ার জন্য আমাকে কতটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। কতজনের হাত-পা ধরতে হয়েছে। আজ আমি এখানে অনেকটা সময় ভিক্ষা চেয়ে নিয়ে এসেছি। শুধুমাত্র আপনার সাথে দেখা করার জন্য। আপনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শুধু একটা প্রশ্ন করার জন্য”।

বলতে বলতে রিয়ানা কান্না করে দিলো। চোখের অশ্রুকে মুছে রিয়ানা পুনরায় বললো,

_ ” আজ আমি আপনার কাছে জানতে এসেছি, আমি আপনার অবৈধ সন্তান নাকি জয় সাহেবের বৈধ সন্তান”?

রিয়াদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। রিয়ানা মাত্র কি বললো! সে তার অবৈধ সন্তান নাকি জয়ের বৈধ সন্তান! এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য তার সাথে দেখা করতে এসেছে।

রিয়াদকে চুপ থাকতে দেখে রিয়ানা পুনরায় বললো,

_” জানেন আপনি এই একটা প্রশ্নের উত্তর জানি না বলে আজ আমার ভালোবাসা আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা আপনি বুঝেন? বুঝবেন কি করে? আপনি তো অন্যের ভালোবাসা কেড়ে নেওয়ার মানুষ, ভালোবাসা হারানোর ব্যাথা আপনি কি করে বুঝবেন”?

রিয়াদের পক্ষে আর নিরব থাকা সম্ভব নয়। পৃথিবীর অন্যকেউ যদি তাকে এই কথাটি বলতো তাহলে সে নিরবে কেটে পড়তো কিন্তু আজ তার পক্ষে কেটে পড়া সম্ভব নয়। নিরবতা ভেঙে রিয়াদ বললো,

_” ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা আমি জানি নাকি জানি না সেটা নাহয় তুমি আমার গল্পটা শুনেই বিবেচনা করো”।

রিয়ানা রিয়াদের মুখশ্রীতে তাকালো। রিয়াদ খুব শান্তভাবে বললো,

_” তুমি জানতে চাও কে তোমার বাবা? আমি নাকি জয়”?

_ “হ্যাঁ জানতে চাই”।

_ ” গল্পটা শুরু থেকে শোনো, তারপর তুমি নিজেই বুঝতে পারবে কে তোমার বাবা”?

রিয়ানা আগ্রহ ভরা দৃষ্টি নিয়ে রিয়াদের দিকে তাকিয়ে রইলো। রিয়ানা জানে না তার জন্য কি অপেক্ষা করছে! সে কি শুনতে চলেছে! সে শুধু জানে তার সবকিছু জানার অধিকার আছে, তাকে জানতেই হবে সবকিছু!

রিয়াদ উল্টোদিকে ঘুরে বলতে লাগলো,

১৯৮৭ সাল,

গ্রামের নাম চাঁদপুর। গ্রামে একসাথে বেড়ে ওঠা চার কিশোর-কিশোরী রিয়াদ, নদী, জয়, স্বপ্না। একে-অপরের সহপাঠী ছাড়াও খুব ভালো বন্ধু তারা।

তখন সময়টা অষ্টম শ্রেনি থেকে নবম শ্রেণিতে পদার্পন করার। অষ্টম শ্রেনির বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলের শেষে নবম শ্রেণিতে পা রাখার। সে বছর সবার থেকে বেশি নাম্বার পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলো রিয়াদ। রিয়াদ সেদিন খুব খুশি ছিলো, তার খুশিকে ভাগ করে নিতে নদীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিলো। রিয়াদ ভেবেছিলো নদীর দু’চোখে তার ভালো ফলাফলের জন্য খুশি ফুটে উঠবে। কিন্তু সে ভুল ছিলো। সেদিন নদীর দু’চোখে খুশি নয় দুঃখ ছিলো। নদী কান্না করছিলো। নদীর কান্না দেখে রিয়াদ প্রশ্ন করলো,

_ “তুই কান্না করছিস কেন”?

নদী কাঁদতে কাঁদতে বললো,

_ ” তুই কেন এত ভালো করলি রে রিয়াদ? একটু খারাপ করলে খুব কি ক্ষতি হতো”?

রিয়াদ চমকে নদীর কান্নারত মুখশ্রীতে তাকিয়ে রইলো। রিয়াদের ভাবনায় এলো, নদী হয়তো নিজে তার চেয়ে খারাপ করায় কষ্ট পাচ্ছে। রিয়াদকে ভুল প্রমান করে নদী পুনরায় বললো,

_ ” তুই জানিস আমার কথা আসা ছিলো জয় প্রথম হবে। জয়ের প্রথম হওয়ার খুশিতে আমি আজ মুক্ত পাখির মতো উড়ে বেড়াবো। কিন্তু তোর জন্য জয় প্রথম হতে পারলো না”।

উপরোক্ত কথাগুলো বলে নদী কান্না করতে লাগলো। নদীর চোখে অশ্রু দেখে রিয়াদের মন বলে উঠলো,

_” সে কি জানে না তার চোখের অশ্রু আমার হৃদয়ে দহনের সৃষ্টি করে”।

নিজেকে শান্ত করে রিয়াদ বললো,

_ ” জয় যেমন তোর বন্ধু আমিও তো তোর বন্ধু, তাহলে আমার খুশিতে তুই খুশি নয় কেন”?

নদী এবার ভয়মিশ্রিত কন্ঠে বললো,

_ ” আমি না একটা ভুল করে ফেলেছি রিয়াদ। গ্রামের লোক যারে পাপ বলে সেই পাপটা আমি করে ফেলেছি”।

_” পাপ! কিসের পাপ”?

_” ভালোবাসার পাপ”।

রিয়াদ চমকে উঠলো নদীর কথায়। ভালোবাসা! ভালোবাসাটা ঠিক কি! তার সংঙ্গা রিয়াদ জানে না। তবে রিয়াদের মনে নদীর জন্য আলাদা এক অনুভূতি আছে। আচ্ছা এই অনুভূতিই কি ভালোবাসা!

_” জানিস রিয়াদ তুই আমার বন্ধু তাও আমি তোর খুশিতে খুশি হতে পারছি না। কারন আমার মনে জয়ের জন্য অন্যরকম এক অনুভূতি আছে। আমি তোকে এই অনুভূতির কথা বলে বোঝাতে পারবো না। তুই প্রথম হওয়ায় আমার আনন্দ হয়েছে, তবে ততটা নয় যতটা জয় হলে হতো”।

রিয়াদ নিজের মুখশ্রীতে হাঁসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বললো,

_” জয় প্রথম না হওয়ায় তোর খুব কষ্ট হচ্ছে তাই তো”?

_” হ্যাঁ”।

রিয়াদ নিজের হাতে নদীর চোখের অশ্রু মুছে দিলো। তারপর বললো,

_ ” এবার হয়নি তো কি হয়েছে, পরের বার হবে। আমি নিজে জয়কে প্রথম হওয়ার উপযোগী করে তৈরি করবো”।

নদী রিয়াদের কথায় ভরসা পেলো। কিছুটা খুশি হয়ে বললো,

_” সত্যি বলছিস”?

_” একদম”।

_ ” তাহলে পরের বার থেকে আমরা ফলাফলের দিন খুব ভালোভাবে উপভোগ করবো”।

_ ” আচ্ছা”।

নদী মনেমনে শান্তি খুঁজে পেলো। এখন মনে হচ্ছে কিছুটা কষ্ট কমেছে। রিয়াদ এবং নদীর কথার মাঝেই স্বপ্না আর জয় চলে এলো। স্বপ্না খুশি মনে বললো,

_” কি রে নদী রিয়াদকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলি বুঝি”?

নদীর উত্তর দেওয়ার পূর্বেই রিয়াদ বললো,

_” আরে না, শুভেচ্ছা দেওয়ার মতো কি হয়েছে? স্যাররা ভুল খাতা দেখেছে নয়তো জয় প্রথম হতো”।

জয় চমকে রিয়াদের মুখের দিকে তাকালো। রিয়াদকে সমর্থন জানিয়ে নদী বললো,

_” হ্যাঁ আমারো তাই মনে হয়। তবে পরেরবার নিশ্চয় জয় প্রথম হবে”।

_” হতেই হবে”।

রিয়াদ মুখে হাঁসি ধরে রেখে বললো। রিয়াদ এবং স্বপ্নাকে বিদায় জানিয়ে নদী জয়ের হাত ধরে অন্যদিকে নিয়ে গেলো। রিয়াদ ওদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে মুচকি হাঁসলো। স্বপ্না বললো,

_” ওরা দু’জন বোধহয় আইসক্রিম খেতে গেলো। আমাদের রেখে চলে গেলো, চল আমরাও যাই”।

_ ” না থাক। থাকুক না ওরা একসাথে কিছুটা সময়”।

একটু থেমে রিয়াদ পুনরায় বললো,

_” চল আমরা বরং এদিকে যাই”।

_ ” আচ্ছা”।

স্কুল থেকে বাড়ির পথে রওয়ানা দিলো রিয়াদ এবং নদী। নদী এবং রিয়াদের বাড়ি একদিকে আর জয়, স্বপ্নার বাড়ি অন্যদিকে। মাঝপথ অব্দি একসাথে এসে তাদের গন্তব্য আলাদা হয়ে যায়। রিয়াদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে নদী বললো,

_” জানিস তখন জয়ের সাথে যাওয়ার পর কি হয়েছে”?

_” কি হয়েছে”?

নদী বলতে লাগলো,

তখন জয়ের হাত ধরে নদী নিয়ে গেলো রহিম কাকার আইসক্রিম এর দোকানের সামনে। নদী জয়ের হাত ধরে রাখা অবস্থায় বললো,

_” কাকা একটা আইসক্রিম দেন”।

রহিম কাকা আইসক্রিম দিলে তা নিয়ে জয়ের হাত ধরেই অন্যদিকে নিয়ে গেলো। পুরোটা সময় জয় নদীর ধরে রাখা হাতটার দিকে তাকিয়ে রইলো। জয় কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,

_”একটা আইসক্রিম আনলি কেন”?

_ ” খাবো তাই”।

_” খাবি তা তো বুঝলাম কিন্তু আমায় দিবি না”?

_ ” তোকে দিব না কেন”?

_ ” তাহলে একটা আনলি কেন”?

_ ” একটা দু’জনে খাবো তাই”।

_” মানে”?

জয় মুখ খুলতেই নদী জয়ের মুখে আইসক্রিমের কিছুটা অংশ দিলো। জয় হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। নদী তাড়া দিয়ে বললো,

_” নে খা”।

জয় নিলো। জয় নেওয়ার পর জয়ের খাওয়ার স্থান দিয়েই নদী খেলো। জয় মজা করে বললো,

_” কি ব্যাপার আজ আমার হাত ধরে এখানে ওখানে যাচ্ছিস, এক আইসক্রিম দুজন। ঘটনা কি”?

_” কিসের ঘটনা”?

_” তোর আজ হয়েছে কি”?

_” কিছুই না”।

_ ” ভয় করছে না, এভাবে একটা ছেলের হাত ধরে এখানে ওখানে যেতে! লোকে দেখলে বদনামি হবে তো”?

_” এত ভয় নিয়ে কি আর অনুভূতি হয়”?

_” কি”?

জয় কৌতূহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো নদীর দিকে। তখনি নদী জয়ের থেকে দৌড়ে পালিয়ে এলো। জয় মুচকি হাঁসলো। জয়ের মুচকি হাঁসি নদী আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখলো।

রিয়াদের কাছে উপরোক্ত কথাগুলো বলতে বলতে নদী লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। নদী মুখশ্রীতে লজ্জার আভা দেখে রিয়াদে বুকে দহনের সৃষ্টি। এই দহনটা জানান দিচ্ছে, ” এ লজ্জারাঙা মুখশ্রী তোর জন্য নয়”।

রিয়াদ স্বাভাবিকভাবে বললো,

_” জয় হাঁসলো তো কি হয়েছে”?

_” তুই না কিছু বুঝিস না রিয়াদ। আরে ও হেঁসেছে মানে ও আমার অনুভূতির সঙ্গ দিতে চাচ্ছে। মানে ও আমাকে ভালোবাসে”।

_ ” যদি না বাসে”?

নদী চমকে রিয়াদের মুখে হাত দিলো। ভয় নিয়ে বললো,

_” এরকম বলিস না রিয়াদ, মরেই যাবো”।

মরার কথা শুনে রিয়াদ চমকে উঠলো। রিয়াদের বলার ভাষা হারিয়ে গেছে। নদী পুনরায় বললো,

_” তুই বুঝবি না রিয়াদ এই অনুভূতি কত প্রখর! সমাজের ভয়কে পিছনে ফেলে যে অনুভূতি এগিয়ে যেতে পারে, সে অনুভূতি হেরে গেলে যে মৃত্যু ছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই রিয়াদ। এই অনুভূতির আগুন যে আমায় ধীরে ধীরে পুরিয়ে মারবে”।

_” এটা কিশোরী মনের আবেগ নদী”।

মনের মধ্যে আসা নিয়ে রিয়াদ কথাটি বললো। কিন্তু রিয়াদের আসার বাগানে ফুল ফুটে উঠলো না। নদী বললো,

_” আবেগ দিয়েই ভালোবাসা হয়। আমি জানি না এটা আবেগের ভুল কিনা! শুধু জানি তার হার আমার সহ্য হয় না, তার অন্ধকার মেঘাচ্ছন্ন মুখশ্রী আমার পছন্দ না। দেখলি না ওর হারে কিভাবে কান্না করলাম! আমার মন ওকে জয়ী দেখতে চায়। এটা আবেগের পরে জন্ম নেওয়া ভালোবাসা”।

কথা বলতে বলতে নদী হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে নিচ্ছিলো কিন্তু পড়ে যাওয়ার পূর্বেই রিয়াদ ধরলো। নদীকে ধরে রেখেই রিয়াদ বললো,

_” আমি তোকে কখনো হোঁচট খেয়ে পড়তে দেবো না নদী”।

নদী মুচকি হেসে বললো,

_” এজন্যই তো তুই আমার খুব ভালো বন্ধু”।

দু’জনেই খুশি মনে বাড়ি চলে গেলো।

রিয়াদ বাড়ি ফিরতেই তার আম্মা বললো,

_” বাজান পরীক্ষার ফলাফল কেমন হলো”?

_ ” আম্মা আমি দ্বিতীয় হইছি”।

রিয়াদের মুখশ্রীতে বিষাদের ছায়া দেখে রিয়াদের আম্মা বললো,

_” মন খারাপ করিস না বাজান। ভালাই তো করছো। আইজ তোর আব্বায় বাঁইচা থাকলে মেলা খুশি হইতো। তার পোলা দুই হইছে। দুই হওয়া কি চারটি খানি কথা”।

কথাটি বলে আম্মা রিয়াদের মাথায় হাত রাখলেন। যে হাতের স্পর্শে অনেকটা স্নেহ, ভালোবাসা ছিলো। যার ছোঁয়ায় সব কষ্ট দূর হয়ে যায়। রিয়াদ হঠাৎ তার আম্মাকে জড়িয়ে ধরলো। জড়িয়ে ধরে মনেমনে বললো,

_” ক্ষমা কইরো আম্মা। এতদিন প্রথম স্থানে থেকে যে আনন্দটা পেয়েছিলাম, আজ সেই আনন্দ পাচ্ছি না আম্মা। তাই তো দ্বিতীয় বললাম”।

image

পর্ব দুই

কেটে গেলো কয়েক মাস। দিনগুলো সবার যাচ্ছে বেশ। ক্লাসে শিক্ষকদের সাথে রেসপন্স করার বাহবাটা জয় পাচ্ছে। জয় পাওয়া নদী খুশি আর নদীর খুশিতে রিয়াদ খুশি। সময় যত যাচ্ছে প্রত্যেকের হৃদয়েই অনুভূতিগুলো আরো প্রখর হয়ে ধরা দিচ্ছে।

তখন সময়টা শরৎ। নদীর তীরে হাওয়ায় দুলছে কাশের বন, ঘাসের উপর শুভ্র চাদর বিছিয়ে দিয়েছে শিউলির দল। ঋতুটা বেশ পছন্দের নদীর। পছন্দের এই ঋতুতে যদি মনের মানুষের থেকে প্রেম নিবেদন পাওয়া যায় তবে মন্দ নয়।

ঠিক তেমনি হলো, সেদিন ক্লাস শেষে জয় নদীকে স্কুলের পিছন দিকটায় ডাকলো। রিয়াদ এবং স্বপ্নাকে নিয়ে নদী পিছনের দিকে চলে গেলো। রিয়াদ, স্বপ্নার সামনেই সেদিন জয় একগুচ্ছ শিউলি ফুল এগিয়ে দিয়ে বললো,

_” গোলাপ দেইনি বলে ফিরিয়ে দিও না। ভালোবাসা সত্যি হলে, ফুলটা গোলাপ না শিউলি তাতে কি এসে যায়”?

একটু থেমে পুনরায় বললো,

_” ভালোবাসা কিভাবে প্রকাশ করতে হয় আমি জানি না। তবে এতটুকু জানি যতটা ভালোবাসলে কাউকে চোখ বন্ধ করলেও অনুভব করা যায়, ঠিক ততটাই ভালোবাসি। হ্যাঁ হ্যাঁ ভালোবাসি। খুব খুব ভালোবাসি নদী। সারাজীবন তোর সাথে পথ চলতে চাই”।

নদীর থ হয়ে গেলো। বলার মতো ভাষা তার জানা নেই। এতদিনে নানাভাবে নিজের অনুভূতি জানান দিয়েছিলো নদী। আজ জয়ের অনুভূতি জানতে পেরে মনের ভিতর কি বয়ে যাচ্ছে, সেটা একমাত্র নদীই জানে!

রিয়াদ ব্যাথিত হৃদয় নিয়ে নদীর মুখশ্রীতে তাকিয়ে রইলো। যদিও সে জানে নদীর উত্তর কি হবে! তবুও বেপরোয়া মন চাচ্ছে, উত্তরটা না হোক। স্বপ্না নদীকে ধাক্কা দিয়ে বললো,

_” জয় উত্তরের অপেক্ষা করছে নদী, উত্তরটা দে”।

নদী লাজুক হেঁসে ফুলগুলো নিয়ে বললো,

_” আমিও ভালোবাসি”।

কথাটি বলেই ছুটে পালালো নদী। নদীর পালানো দেখে জয়ও নদীর পিছন পিছন দৌড় দিলো। স্বপ্না জয়কে যেতে দেখে পিছু ডাকতে নিলে রিয়াদ বললো,

_” পিছু ডাকিস না। সময়টা এখন ওদের। সময়ের সঙ্গ না দিতে পারিস বাঁধা অন্তত দিস না”।

_” আচ্ছা”।

স্বপ্না চলে গেলো। রিয়াদ সেখানে দাঁড়িয়ে নিরবে কেঁদে গেলো। কিছুক্ষণ পর নিজেকে শান্ত করে নিজের মনকে বললো,

_” ভোগে নয় ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। পূর্ণতা নয় মাঝেমাঝে অপূর্ণতাও সুখী হওয়া যায়”।

জয়ের সাথে খুনসুটিতে বেশ অনেকটা সময় কেটে গেলো নদীর। বাসায় ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধ্যা। বেশ ভয় নিয়ে বাসা প্রবেশ করলো। বাসায় ডুকতেই আম্মার মুখোমুখি হলো নদী। নদী বেশ ভয় পাচ্ছে। তার আম্মা তাকে কি না কি বলে! কিন্তু নদীকে অবাক করে দিয়ে তার আম্মা বললো,

_” স্বপ্নার আব্বা, আম্মা কেমন আছে”?

_ ” স্বপ্নার আব্বা, আম্মা”?

_ ” হ তুই না ওগো বাড়ি থেইকা আইলি”?

নদী কিছু বুঝতে পারলো না। নদীর আম্মা পুনরায় বললো,

_” তুই না এতক্ষন ওগো বাড়ি আছিলি তয় ওর আব্বা, আম্মা কেমন আছে কইতে পারো না ক্যান”?

_” না মানে আমি যে ওদের বাসায় ছিলাম এটা তুমি জানলে কিভাবে”?

_” রিয়াদ কইলো। তোর আইতে দেড়ি হইতে পারে দেইখা রিয়াদ বাড়িতে আইয়া কইয়া গেলো। নোট নিতে স্বপ্নাগো বাড়ি গেছোস”।

_” ওহ হ্যাঁ গেছিলাম তো। ওর আব্বা, আম্মা বেশ ভালো আছে”।

_” তয় যা হাত-মুখ ধুইয়া নে”।

_” হ্যাঁ”।

নদী তাড়াতাড়ি করে কেটে পড়লো। আজ রিয়াদ ছিলো বলে বেঁচে গেছে।

সন্ধ্যার কিছুটা সময় পর রিয়াদের বাড়িতে জয়ের আগমন ঘটলো। রিয়াদ নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছিলো। শরীরটা ভালো লাগছিলো না তাই ঘুম দিচ্ছিলো। জয় রিয়াদের আম্মার সাথে সৌজন্যমূলক বাক্য বিতরণ করে রিয়াদের ঘরে গেলো। রিয়াদকে ঘুম থেকে তুললো। রিয়াদের রেশ তখনো কাটেনি। ঘুম ঘুম কন্ঠেই বললো,

_” জয় হঠাৎ আমার বাড়ি”?

_” কেন আসতে পারি না”?

_” তা নয় কখনো রাতে আসিস না তো তাই”?

_” হ্যাঁ আজ একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজে এসেছি”।

_” কি কাজ”?

জয় পকেট থেকে একটি ভাঁজ করা কাগজটি বের করে রিয়াদের সামনে ধরলো। করুনভাবে বললো,

_” প্লীজ এই চিঠিটা নদীকে দিয়ে আয় না”?

_” কি? এখন আমি নদীর বাসায় যাবো”?

_” হ্যাঁ সমস্যা কি”?

_” তোর মাথা খারাপ। এখন গেলে লোকে কি ভাববে”?

_” কিছুই ভাববে না। সবাই জানে তোরা প্রতিবেশি এবং একসাথে পড়িস তাই কোন সমস্যা নেই”।

_” সমস্যা নেই বললেই সবকিছু….

রিয়াদের কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে জয় বললো,

_ ” দেখ ভাই আমি কিছু জানি না, আমার অনেকদিনের শখ প্রেয়সীর সাথে চিঠি আদান-প্রদানের মাধ্যমে প্রেম করবো। এখন তুই আমার ইচ্ছেটা পূরণ কর”।

রিয়াদ কিছু বলতে নিলে জয় আরো দু’বার অনুরোধ করে। রিয়াদ বাধ্য হয়ে রাজি হয়ে যায়।

চিঠি নিয়ে রিয়াদ নদীর বাড়িতে আসে। খুব ভদ্রভাবে নদীর আম্মাকে বলে,

_” কাকীমা নদী স্বপ্নার থেকে যে নোটগুলো এনেছে, ওগুলো আমারো প্রয়োজন তাই নিতে এসেছি”।

_” আচ্ছা”।

নদীর আম্মা নুপুরকে(নদীর বোন) উদ্দেশ্য করে বলে,

_” নুপুর আপারে ডাক দে, ক রিয়াদ আইছে”।

_” আচ্ছা আম্মা”।

নুপুর ভিতরের ঘর থেকে নদীকে ডেকে নিয়ে আসে। নদী এই অসময়ে রিয়াদকে দেখে বেশ চমকালো। রিয়াদ একবার নদীর আম্মার দিকে আর একবার নদীর দিকে তাকিয়ে অসহয় কন্ঠে বললো,

_” তুই যে নোটগুলো এনেছিস সেগুলো আমারে দে”।

নদী কিছু বুঝতে পারলো না। তবে রিয়াদের আসার কারনটা জরুরি ভেবে নদী বললো,

_” আয় আমার ঘরে আয়, আমি বের করে দিচ্ছি”।

রিয়াদ নদীর আহ্বান পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ভিতরের ঘরে গেলো। ঘরে গিয়েই চিঠিটা নদীর হাতে তুলে দিয়ে বললো,

_” জয় দিয়েছে, বলেছে উত্তরটা কাল লিখে নিয়ে যেতে”।

একটু থেমে পুনরায় বললো,

_” আর হ্যাঁ কাল থেকে এভাবেই চিঠি আদান-প্রদানে প্রেম নিবেদন হবে। তবে আমি ডাকপিয়ন হতে পারবো না, তাই নিজেদের মতো করে ভাবনা চিন্তা কর। কিভাবে পত্রপ্রেম করা যায়”!

রিয়াদ এতটুকু বলেই নদীর একটা খাতা নিয়ে চলে গেলো। নদী রিয়াদকে কিছু বলতে নিচ্ছিলো কিন্তু রিয়াদ শুনলো না। কারন রিয়াদ জানে এখন নদীর কথা শোনা মানেই জয় চিঠিতে যা লিখেছে তা পড়ে শোনাবে। চিঠিতে কি লেখা আছে জানা নেই কিন্তু চিঠির ভাষা শোনা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

রিয়াদ চলে যেতেই নদী চিঠির ভাজ খুলে পড়তে লাগলো,

প্রেয়সী আমার,

ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি।

পুরো চিঠি জুড়ে শুধু এতটুকুই লেখা। এতটুকু লেখাই নদীর হৃদয়ে অনুভূতির এক শিহরণ জাগিয়ে তুললো।

চিঠিটাকে বুকে জড়িয়ে নদী মনেমনে বললো,

_” ভালোবাসা এত সুন্দর কেন”!

পরেরদিন নদী জয়ের সাথে দেখা করতে যাওয়ার পূর্বে রিয়াদ এবং স্বপ্নার সাথে দেখা করলো। এখন নদী ওদের দু’জনের মুখোমুখিই বসে আছে। নদী জয়ের উদ্দেশ্য চিঠি লিখবে, এখন কি লেখা যায় সেটাই ভাবছে! অনেক্ক্ষণ ভেবে নদী রিয়াদকে বললো,

_” তুই বল না কি লিখবো? তুই তো একজন ছেলে, ছেলে হয়ে বুঝিস না অন্য একজন ছেলে কি ধরনের লেখা পছন্দ করবে? যে লেখার মাঝে হাজারো অনুভূতি খেলা করবে, আর সে অনুভূতির ভেলায় সে হারিয়ে যাবে”।

স্বপ্না মজা করে বললো,

_” তুইতো বেশ ডুবে যাচ্ছিস সেই অনুভূতিতে”।

_ ” যাচ্ছি তো”।

_” বাহ ডুবে ডুবে ভালোই জল খাচ্ছিস”।

_ ” তোকে জল খেতে কে বারণ করছে”?

_” কাউকে তো পাচ্চি না রে, কি করবো বল? আমারজনকে তো তুই নিয়ে নিয়েছিস”।

_” কি”?

নদী চমকে জিজ্ঞেস করলো। স্বপ্না হাঁসলো। হাঁসি ধরে রেখেই বললো,

_” মজা করলাম”।

_” তাই বল”।

একটু থেমে নদী পুনরায় বললো,

_” বল না কি লিখবো চিঠিতে”?

রিয়াদ মুচকি হেঁসে বললো,

_” চার অক্ষরের ভালোবাসায় বড্ড মায়া। মায়ার সেই চাদরে জড়াতে চাই সারাজীবন”।

নদী রিয়াদের মুখশ্রীতে তাকাতেই রিয়াদ বললো,

_” এটাই লেখ”।

নদী কিছু বলার পূর্বেই স্বপ্না বললো,

_” রিয়াদ সেই চাদরে কার সাথে জড়াতে চাস”?

রিয়াদ মুখে হাঁসি ধরে রেখেই বললো,

_” সে মনের গহীনে খুব সযত্নে নিজের বসত গড়ে তুলেছে। তার গল্প মনের গহীনেই গড়ে উঠুক”।

নদী সন্দিহান দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,

_” কাউকে ভালোবাসিস রিয়াদ”?

_” উল্টা পাল্টা না বকে যেটা বললাম সেটা লেখার হলে লেখ নয়তো যা”।

_” যাবো তো অবশ্যই তবে লিখে যাবো। তোর কথাটা আমার ভালো লাগে, তাই ওটাই লিখবো”।

_” তো লেখ”।

নদী কথাগুলো লিখে কাগজ ভাজ করে নিয়ে চলে গেলো। জয় হয়তো এতক্ষনে চলে এসেছে। নদী চলে যেতেই স্বপ্না বললো,

_” ভালোবাসিস কাকে”?

_” তুই আবার উল্টা বকা ধরলি কবে থেকে”?

_” উল্টা হোক বা সোজা, বল না কারে ভালোবাসিস”?

_ ” যে আমার নয় তারে”।

রিয়াদ চলে যেতে নিলে স্বপ্না বলে,

_” প্রকাশ করে দেখ, হয়তো সে তোরই”।

রিয়াদ পিছন ঘুরে তাকালো। স্বপ্নার উপরোক্ত কথাটি রিয়াদের বোধগম্য হলো না। স্বপ্না দিকে তাকিয়ে দেখলো সে লজ্জা পাচ্ছে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বুঝতে না পেরে রিয়াদ চলে গেলো। বুঝতে পারলো না নাকি বুঝতে চাইলো না। কে জানে!

পর্ব তিন

বছরটা পার হয়ে গেলো। দশম শ্রেনিতে পদার্পন করলো সবাই। আজ নদী খুব খুশি, তার ভালোবাসা জয় প্রথম স্থান অর্জন করেছে। সবাই জয়কে বাহবা দিচ্ছে। অন্যদিকে জয়ের এই প্রথম স্থান অর্জন করার পিছনে যে মানুষটা নিজেকে একধাপ পিছিয়ে নিয়েছে তার নামটা কারোই জানা নেই। নদীর খুশিতে সেই মানুষটাও খুশি। সেই মানুষটা অন্যকেউ নয় রিয়াদ। পরিক্ষা খাতায় কিছুটা মার্ক ছেড়ে দিয়েছিলো রিয়াদ। রিয়াদের আগে থেকেই ধারনা ছিলো জয় কতটা মার্ক পেতে পারে। সেই ধারনা থেকেই নিজের খাতায় কিছুটা মার্ক ছেড়ে আসলো।

রিয়াদ স্কুলের মাঠে একা বসে ছিলো। কোথা থেকে জেনে নদী ছুটে এলো তার কাছে। ছুটে এসে রিয়াদের পাশে বসলো। খুব দ্রুত বললো,

_” তুই এখানে আর আমি তোকে পুরো স্কুল খুঁজে মরছি”।

রিয়াদ অন্যমনস্ক হয়ে বললো,

_” তুই আমাকে খুঁজছিলে বুঝি”?

_” হ্যাঁ”।

_” আজ তো তোর জয়কে নিয়ে থাকার কথা, সেখানে আমাকে খোঁজাটা বড্ড বেমানান নয়”?

_” আরে আমি তো তোকে জয়ের জন্যই খুঁজছিলাম”।

রিয়াদ অবাক হয়ে বললো,

_” জয়ের জন্য মানে”?

_” তুই তো জানিস আমি ভালো চিঠি লিখতে পারি না। কি লিখবো ভেবে পাচ্ছি না! জয়কে শুভেচ্ছা জানিয়ে একটা চিঠি লিখতে চাচ্ছি। বলনা কি লিখবো”!

রিয়াদ মনেমনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

_” অনেক তো হলো, নিজের চিঠি এবার নিজে লেখ। অনুভূতিটা তোর সেখানে ভাবনাটা অন্যকারো হলে, সেটা ভালো দেখায় না”।

_” তার মানে তুই আমাকে সাহায্য করতে চাচ্ছো না”?

_” উহ সাহায্য করতে চাচ্ছি, তবে অন্যভাবে”।

_” মানে”?

_” কাগজ, কলম বের কর”।

নদী দ্বিমত না করে কাগজ, কলম বের করে রিয়াদের দিকে এগিয়ে দিলো। রিয়াদ সেটা না নিয়ে বললো,

_” তুই লেখার মতো করে কলমটা ধর”।

নদী রিয়াদের মুখশ্রীর দিকে তাকালো। রিয়াদ চোখের ইশারায় কলম ধরতে বললো। নদী রিয়াদের কথামতো কলমটি হাতে নিলো। এবার রিয়াদ বললো,

_” চোখ বন্ধ কর”।

নদী এবারো কিছু বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু রিয়াদ ইশারা চুপচাপ ওর কথা শুনতে বললো। নদী নিজের চোখ বন্ধ করে নিলো। রিয়াদ শান্তসুরে বললো,

_” জয়ের সাথে কাটানো সবচেয়ে সুন্দর মূহুর্তটাকে স্মরণ কর”।

একটু থেমে রিয়াদ পুনরায় বললো,

_” সেই সাথে আজ তুই কতটা খুশি তাই নিয়ে ভাব। তারপর যা মনে আসে তাই লিখে ফেল”।

নদী চোখ বন্ধ করেই ভাবনার জগতে চলে গেলো। এই এক বছরে জয়ের সাথে চিঠি আদান-প্রদান করা, ঘোরাফেরা সবি হলো। সবকিছুই নদীর কাছে সুন্দর মূহুর্ত। তবে এই মূহুর্তে সুন্দর মূহুর্ত বলতে যেটা মনে পড়ছে সেটা হলো,

সেদিন জয়ের সাথে দেখা করার পর জয় বললো,

_” প্রেয়সী”।

জয়ের বলা প্রেয়সী শব্দটি নদীর বুকে শিহরণ জাগিয়ে দিলো। নদী অনুভূতির সাগরে ডুব দিয়ে দিলো। ডুবন্ত নদীকে ডাঙায় ফেরত নিয়ে আসলো জয়ের কাতরসুর। জয় বললো,

_” প্রেয়সী আমার একটা ইচ্ছে পূরণ করবে”?

_” কি ইচ্ছে”?

_” আমার না তোমার সাথে নিরিবিলি পথে হাঁটতে খুব ইচ্ছে করছে”।

_” এখন”?

_” হু”।

_” কিন্তু এখন..

নদী কথাটি সমাপ্ত করতে পারিনি তার পূর্বেই জয় করুনারসুরে বললো,

_” প্লীজ ইচ্ছেটাকে মেরে ফেলার মতো বাক্য উচ্চারণ করো না”।

জয়ের কাতরসুর নদী উপেক্ষা করতে পারেনি। তাই রাজি হয়ে গেলো।

পাশাপাশি দু’জন প্রেমিক-প্রেমিকা হেঁটে চললো। ভালোবাসা দু’জনের মধ্যেই বিদ্যমান। দু’জনের অনুভূতির ভাষায় দু’জন দু’জনকে বড্ড চায়। তারা জানে না তাদের চাওয়াটা পূর্ণ হবে কি না! হঠাৎ নদী ‘আহ’ শব্দ করে উঠলো। জয়ে সাথে সাথে ব্যকুল হয়ে পড়লো।

_” কি হয়েছে? কোথায় ব্যাথা পেলে প্রেয়সী”?

নদী মুচকি হেঁসে জয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। জয় নদীর জবাব না পেয়ে বললো,

_” কি হলো বলো না? কি হয়েছে তোমার? কোথায় ব্যাথা পেলে”?

নদী অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। হাঁসতে হাঁসতেই বললো,

_” কিছুই হয়নি আমার। স্বপ্না একদিন এরকম করতে বলছিলো, দেখতে বলছিলো তোমার হাবভাব। সেটাই দেখছিলাম”।

জয় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। জয়ের ভ্যাবলাকান্ত সেই মুখশ্রী দেখে বেশ মজা পাচ্ছিলো নদী। সেদিনকার অনুভূতিটা নদীর কাছে অন্যরকম ছিলো। হয়তো কাজটা ছেলে-মানুষির ছিলো। তবুও ক্ষতি কি, হোক না কিছু অনুভূতি বোকামোর।

স্মৃতি থেকে বেরিয়ে নদী লিখতে লাগলো,

প্রিয়,

তোমার সাথে কাটানো প্রতিটি মূহুর্তই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি মূহুর্তই ভালোবাসার। আমার সেই ভালোবাসার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার সাধ্য আমার নেই।

তোমার জয়ের এই দিনে শুভেচ্ছা জানানোর মতো ভাষাও আমার নেই। শুধু ছোট্ট শব্দে অনুভূতি প্রকাশ করলাম। বুঝে নিয়েই সেই শব্দের গভীরতা। সেই ছোট্ট শব্দটি হলো, ‘ভালোবাসি’।

এছাড়া শুভেচ্ছা জানানোর মতো ভাষা আমার জানা নেই।

ইতি

তোমার প্রেয়সী

চিঠিটা লিখে নদী রিয়াদকে পড়ে শোনালো। রিয়াদ মুখে হাঁসি নিয়ে বললো,

_” বেশ ভালো হয়েছে”।

রিয়াদ ভালো বলেছে মানেই ভালো, এই ধারনা নিয়ে নদী চলে গেলো। রিয়াদ মনেমনে আক্ষেপের সুরে বললো,

_” আমার অনুভূতি প্রকাশ করার মতো সেই ছোট্ট শব্দটা আমার বোধহয় কখনো বলা হবে না”।

পরক্ষণেই বললো,

_” বাস্তবে না সই কল্পনাতেই হোক। কল্পনাতেই বলছি ‘ভালোবাসি’। খুব ভালোবাসি”।

_____

সময়টা বেশ যাচ্ছিলো। জয়ের সাথে সম্পর্কে জড়ানোর পর থেকে নদীর মুখশ্রীতে কখনো মন খারাপের দেখা মেলেনি। কিন্তু আজ নদীর বড্ড মন খারাপ। জয়ের সাথে ঘুরতেও ভালো লাগছে না। তাই জয়কে বিদায় জানিয়ে রিয়াদের সাথে বাসায় ফিরছিলো নদী। রিয়াদ বেশ কিছুক্ষন ধরে লক্ষ্য করছে নদী কিছু বলার চেষ্টা করেও বলতে পাচ্ছে না। নদীকে সুযোগ করে দিতে রিয়াদ বললো,

_” কিছু বলবে”?

_” হ্যাঁ”।

_” তো বল মন খারাপের কারন”?

_” তুই কি করে বুঝলি আমার মন খারাপ? আর আমি তোকে এটাই বলবো”?

_” তোর আনন্দ, সুখ, অনুভূতি, মন খারাপের গল্প শোনার জন্যই তো আমি আছি। তুই খুশির গল্প শোনাতে চাইলে এতক্ষণ ভাবছি না, তাই ধরে নিলাম মন খারাপের গল্প বলবে”।

_” এজন্যই না তোকে এত ভালো লাগে। তুই আমার একমাত্র বন্ধু যাকে আমি আমার সব গল্প খুব সহজেই বলতে পারি”।

_” তো বলে ফেল মন খারাপ কেন”?

নদী কান্না কান্না ভাব নিয়ে বললো,

_” আম্মা বললো এসএসসি শেষে আমার বিয়ে দিয়ে দিবে। কিন্তু জয় তো কিছু করে না, ছাত্র মানুষ। ওর সাথে আমার বিয়েটা কি করে হবে? আব্বা, আম্মা অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দিলে আমি কি করবো”?

রিয়াদের ভাবনা আসছে না এখন কি করা যায়! তবে রিয়াদ এতটুকু জানে এখন কি বললে নদীর মন খারাপ দূর হবে। রিয়াদ শান্তভাবে বললো,

_” বেশ অনেকটা সময় আছে। চিন্তা করিস না। আমি আছি তো ব্যবস্থা হয়ে যাবে”।

_” তুই দায়িত্ব নিবি আমাদের সম্পর্কটা বৈধ করার”?

রিয়াদ চমকে নদীর দিকে তাকালো। নদীর আশাভরা দৃষ্টি রিয়াদের চোখের আড়াল হলো না। রিয়াদ স্বাভাবিক ভাবে বললো,

_” আমি দায়িত্ব নিলে তোর মন খারাপ দূর হবে”?

_” হ্যাঁ হবে। আমি জানি তুই দায়িত্ব নিলে আমাদের সম্পর্কটা পূর্ণতা পাবে”।

_” পেতে নাও হতে পারে”?

_”উহু। আমি নিজের থেকেও বেশি ভরসা করি তোকে। আমি জানি তুই দায়িত্ব নিলে আমার জীবনটা সুন্দর হবে”।

_” এত ভরসা করিস আমায়”?

_” হুম”।

_” কেন”?

_” কারন তুই আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। ছোটবেলা থেকে আমি আমার সবকিছু তোর সাথে শেয়ার করে শান্তি পাই। তোকে বললে আমার সব সমস্যা নিমেষেই শেষ হয়ে যায়”।

রিয়াদ নিরবে হাঁসলো। নিরব হাঁসির মাঝেই হয়তো লুকিয়ে ছিলো একটি বাক্য,

_” বন্ধুত্ব আর ভালোবাসা কখনো এক হয় না বুঝি”।

রিয়াদ নদীকে আশ্বাস দিয়ে বললো,

_” নিলাম দায়িত্ব। যদি আমি দায়িত্ব নিলে তোর মুখে হাঁসি ফোটে তবে নিলাম দায়িত্ব। তোর মুখের হাঁসি ধরে রাখার জন্য হলেও তোদের ভালোবাসার পূর্ণতা করাবো”।

নদী হাসি মুখে বললো,

_” সত্যি”?

_” হ্যাঁ”।

নদী খুশির জোয়ারে ভেসে একটি ভুল করে ফেললো। রিয়াদকে জড়িয়ে ধরলো। রিয়াদকে জড়িয়ে ধরার সাথে সাথে রিয়াদের হৃদয়ে অন্যরকম শিহরণ বয়ে গেলো। রিয়াদ সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিলো। নদী নিজের ভুল বুঝতে পেরে রিয়াদকে ছেড়ে দিলো। রিয়াদকে ছেড়ে দিতেই রিয়াদ চোখ মেলে নদীর দিকে তাকালো। নদী বোকা বোকা মুখশ্রী করে বললো,

_” বন্ধুকে জড়িয়ে ধরায় ক্ষতি কি”?

রিয়াদ কিছু বললো না। দু’জনে এগিয়ে চললো সামনের দিকে। রিয়াদ মনেমনে একবার বললো,

_” সে কি জানে তার মন খারাপ দূর করতে কেউ একজন শত ব্যাথা বুকে নিয়েও, তাকে তার ভালোবাসার হাতে তুলে দিবে”।

পরক্ষণেই মন বলে উঠলো,

_” সে কি কভু জানবে তার হাঁসি কারো হৃদয়ে আনন্দের ঢেউ তোলে”।

পর্ব চার

বেশ কিছুদিন পর, একদিন রাতে রিয়াদের আম্মা রিয়াদের ঘরে আসলো। রিয়াদ বই পড়ছিলো। আম্মাকে আসতে দেখে বই রেখে আম্মার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,

_” কিছু বলবে আম্মা”?

আম্মা রিয়াদের পাশে বসে বললো,

_” হ বাজান”।

_”কি আম্মা”?

_”তোর আব্বা গত হয়েছে মেলা দিন হইলো। তোর আব্বা শহরে ভালো কাম করতো বইলা, তোর ভবিষ্যতের জন্য কিছু জমাইয়া রাইখা গেছিলো। সেই দিয়াই দু’টো বছর কেটে গেছে। এহন জমানো টাকা বেশি নাই। তোর ভবিষ্যতের কথা ভাইবা আমি একখান সিদ্ধান্ত নিয়া আইলাম আইজ”।

_” কি সিদ্ধান্ত আম্মা”?

_” জমানো যা টাকা আছে ঐগুলা দিয়া একটা ব্যবসা শুরু করলে কেমন হয়? এতদিন ছোট ছিলি বইলা আমি কিছু বলিনাই, এহন দুনিয়াটা বোঝার বয়স হইছে তোর তাই…..”।

আম্মার কথা সমাপ্তের পূর্বেই রিয়াদ বললো,

_” আমি বুঝতে পারছি আম্মা তুমি কি বলতে চাইছো। আমি তোমার কথায় রাজি। এখন কিছু না করলে ভবিষ্যতে আমাদের দূর্দিন দেখা দিবে। আব্বার অবস্থা স্বচ্ছল না থাকলে এখনি আমাদের পরিনতি খুব করুন হতো”।

আম্মা খুশি মনে বললো,

_” আমি জানতাম আমার পোলায় ঠিকই বুঝবো”।

_” হ্যাঁ আম্মা। এবার বলো কিসের ব্যবসা করলে ভালো হয়”?

_” সেইটা আমি আগেই ভাইবা রাখছি। দেখ গ্রাম দিয়া বাজারের দূরত্ব খুব একটা কম নয়। রোজ পায়ে হাঁইটা গ্রামের লোকজনের বাজারে যাইতে মেলা কষ্ট হয়। এই তোর কথাই ভাব না, সপ্তাহে একদিন ছুটি পাশ ঐদিন বাজারে দৌঁড়ান লাগে। তাই আমি বলছিলাম গ্রামের মধ্যেই, ঐ যে পচ্চিম দিকটা তোর আব্বার জমি আছে না ওখানে একটা দোকান দিলে কেমন হয়? শহর থেইকা দৈনন্দিন জীবনে লাগে সব জিনিসপত্র নিয়া ওহানে দোকান খুললে ব্যপারটা মন্দ হয় না। স্কুল শেষে আইয়া দোকানে বসবি, আর বন্ধের দিন তো আছেই”।

রিয়াদ আম্মার মুখশ্রীতে তাকিয়ে মুচকি হাঁসলো। তার আম্মা সমস্ত ব্যবস্থা করেই যে আজ এসেছে তা বুঝতে তার আর বাকি রইলো না। মুখে হাঁসি ধরে রেখেই রিয়াদ বললো,

_”বুদ্ধিটা খারাপ নয় আম্মা”।

একটু থেমে পুনরায় কিছুটা সংকোচ নিয়ে বললো,

_” আম্মা একটা কথা বলবো”?

_ ”হ বল”।

_” আম্মা ব্যবসাটা আমি একা করতে পারবো না”।

_” তুই একলা কই বাজান, আমি আছি তো”।

_” আম্মা আমি তোমার থাকাটা অস্বীকার করছি না, আমি জানি আমার ভুল হলে তুমি আমাকে ঠিক রাস্তাটা চিনিয়ে দিবে। আমি আসলে…”।

রিয়াদকে ইতস্তত করতে দেখে রিয়াদের আম্মা বললো,

_”বাজান যা বলার সরাসরি বল”।

_” আম্মা আমি আসলে জয়কে আমার সাথে নিতে চাচ্ছি”।

_” মানে তুই জয়ের লগে ব্যবসা করতে চাচ্ছিস”?

_” হ আম্মা”।

রিয়াদের আম্মা বুঝতে পারলো তার ছেলে কিছু একটা ভেবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ছেলের উপর তার আস্থা আছে। সেই আস্থা রেখেই তিনি বললেন,

_” তোর লগে নিবি জয়রে, তাতে সমস্যা কই”?

_” জয়কে নিলে তুমি অখুশি নও তো আম্মা”?

_” আমি খুশি হইবো না ক্যান? আমার পোলার লগে অন্য একজন কর্মঠ হইলে আমার তো খুশি হওয়ার কথা”।

রিয়াদ খুশি হয়ে আম্মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,

_” সত্যি আম্মা। তুমি খুশি”।

_” সন্তানের খুশিতেই আব্বা, আম্মা খুশি হয় রে বাজান। কিন্তু তোরা ভাবিস আব্বা, আম্মা তোগো কোন কাজ করতে নিষেধ করে মানেই তোগো স্বাধীনতা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। আসলে ব্যপারটা ওমন না। সব আব্বা, আম্মাই চায় তার সন্তান ভালো কাজ করুক, খারাপটা বর্জন করুক। তাই মাঝেমধ্যে ভুল কাজে বাঁধা হইয়া দাঁড়ায়”।

একটু থেমে আম্মা পুনরায় বলেন,

_” ঐইটারে স্বাধীনতায় বাঁধা দেওয়া কয় না রে বাজান। ঐটা হইলো সঠিক স্বাধীন জীবনে দিকে এগিয়ে দেওয়া সন্তানকে”।

আম্মা কথাটা শুনে ছোট্ট একটা বাক্য মনে হতে পারে। কিন্তু বাক্যটি কতটা দীর্ঘ তা সেই বুঝবে, যার মধ্যে বোঝার জ্ঞান রয়েছে।

রিয়াদ আম্মাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

পরেরদিন রিয়াদ তার ব্যবসার কথা জয়কে জানায়। যেহেতু নদী আর জয়ের প্রেমটা বিয়ে অব্দি গড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়, তাই জয় রাজি হয়ে গেলো। পড়ালেখার পাশাপাশি নিজেকে কর্মঠ হিসাবেও গড়ে তোলা যাবে।

নদী জয় এবং রিয়াদের নতুন ব্যবসা খোলার কথাটি শুনে খুব খুশি হলো। ওদের ব্যবসাটা সাফল্যের দিকে অগ্রসর হলে, সম্পর্কটাও পূর্ণতা পাবে বলে ধারনা নদীর। নদী খুশি মনে রিয়াদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো। রিয়াদ কৌতুহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো নদীর দিকে। নদী হাঁসি রেখা টেনে বললো,

_” আরে হাতটা ধর তো। তোদের নতুন ব্যবসার জন্য শুভেচ্ছা জানাচ্ছি”।

_” আমাকে জানাচ্ছেন কেন? যাকে জানানোর তাকে জানা”।

_” আরে ওকে জানিয়ে কি হবে, ব্যবসাটার আসল হাল তো তুই ধরবি। ও তো শুধু নামে থাকবে। আমি জানি তুই ওকে তোর সাথে এজন্যই নিয়েছিস, যাতে আমাদের সম্পর্কটা একটা নাম পায়। তাই শুভেচ্ছা তোকেই জানানো উচিত”।

_” তাই”।

_” হুম। এবার হাতটা তো ধর”।

রিয়াদ নদীর বাড়িয়ে দেওয়া হাতে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিলো। মনেমনে বললো,

_” তার এই খুশিময় মুখশ্রীই আমার প্রাপ্তি”।

নদী চলে গেলো জয়ের সাথে গল্প করতে। সেই ফাঁকে স্বপ্না রিয়াদের দিকে এগিয়ে এলো। রিয়াদ স্বপ্নাকে দেখে সৌজন্যতার হাঁসি দিলো। স্বপ্না খুশি হয়ে বললো,

_” নতুন ব্যবসার জন্য অভিনন্দন ”।

_” ব্যবসাটা এখনো চালু হয়নি”।

_” হয়নি হবে তো”।

_” হুম”।

_” ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে গেলেই বাসায় আমাদের ব্যপারটা জানাবো”।

রিয়াদ চমকে উঠলো। বিষ্ময় নিয়েই বললো,

_” আমাদের ব্যাপারটা মানে”?

_” মানে আমাদের ব্যাপার”।

স্বপ্না আনন্দের সাথে উপরোক্ত কথাটি বললো। রিয়াদ স্বপ্নার উপরোক্ত কথার ভাবার্থ বুঝতে পেরে বললো,

_” এমন স্বপ্ন দেখা উচিত নয় যা ভেঙে গেলে নিজেকেই নিজের চিনতে কষ্ট হয়। আমি চাই না তুই ভুল করিস। তাই বলছি তুই যা ভাবছিস তা ঠিক নয়”।

স্বপ্না কিছু বলতে নিলে রিয়াদ থামিয়ে দিয়ে বললো,

_” এরচেয়ে সহজ ভাষায় বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়”।

রিয়াদ চলে গেলো। রিয়াদের যাওয়ার দিকে দৃষ্টি রেখে স্বপ্না মনেমনে বললো,

_” এতদিন আমাদের মধ্যে যা হয়েছি, তা সবকিছু মিথ্যে। রিয়াদ কি আমাকে ভালোবাসে না? যদি ভালোই না বাসবে তবে ইঙ্গিত কেন দিয়েছিলো”?(মাতারি এটা কি বলল কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে মনুরা)

ধীরে ধীরে সময় বয়ে যাচ্ছে। রিয়াদের আম্মার থেকে দশ হাজার টাকা নিয়ে, রিয়াদ ব্যবসা শুরু করে দিলো। প্রথমে সবকিছু, যেমন শাক, সবজি, আলু, তেল, পিঁয়াজ, মরিচ যা যা দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজন সবকিছুই অল্প অল্প করে কিনে দোকান খুলে বসলো। সেগুলো বিক্রির শেষে, আগের তুলনায় কিছুটা বেশি জিনিসপত্র নিয়ে আসলো। এভাবেই একটু একটু করে বেশি বেশি কিনতে কিনতে ধীরে ধীরে রিয়াদের ব্যবসাটা বড় হতে লাগলো। পড়ালেখার ফাঁকে ব্যবসাটা ভালোই জমে উঠেছিলো। গ্রামের লোকদের বাজারে গিয়ে জিনিসপত্র কিনতে সত্যি খুব অসুবিধা হচ্ছিলো। গ্রামের মধ্যে সদায়ের( চাল, আলু ডালের দোকানকে বলে) দোকান হওয়ায় বেশ ভালো হলো তাদের।

গ্রামের লোকদের কথা চিন্তা করে এসএসসি পরিক্ষার মধ্যেও দোকান খোলা রেখেছে রিয়াদ। জয়কে পরিক্ষার মধ্যে অবসর দিয়ে, নিজেই দোকান খুলে বসতো। দোকানের বেঁচাকেনার পাশাপাশি বই নিয়ে পড়তে লাগলো।

এভাবেই দিন কেটে গেল। এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলো।

নদীর বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ পড়লো। নদী রিয়াদকে সবটা বললো। রিয়াদ নদীদের বাড়িতে আসলো। নদীর পরিবারের সাথে রিয়াদের ভালো জানা-শোনা থাকায় নদী ভরসা পাচ্ছে, তার আব্বা রিয়াদের কথা ফেলতে পারবে না।

রিয়াদ এবং নদীর আব্বা মুখোমুখি বসা। প্রথমে কুশল বিনিময় ছেড়ে রিয়াদ কিছুটা সংকোচ নিয়ে বললো,

_” কাকা আমি আসলে নদীর বিয়ের ব্যপারে কথা বলতে চাচ্ছিলাম”।

_”তাহলে তো মেলা ভালা। আমি তোমার আম্মার লগে এই ব্যাপারে কথা বলতে চাচ্ছিলাম”।

রিয়াদ ব্যপারটা বুঝতে না পেরে বললো,

_”আমার আম্মার সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন মানে”?

_”আমিও আসলে চাচ্ছিলাম তোমার আর নদীর বিয়াটা হোক। তুমি যখন নিজেই বলতে আসছো তখন তো হয়েই গেলো”।

রিয়াদের কান এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না, এইমাত্র সে কি শুনলো! তার আর নদীর বিয়ে। অবাধ্য মন কেন জানি না খুশি হয়ে উঠলো! রিয়াদের স্বার্থপর মন বলে উঠলো,

_”ক্ষতি কি যদি তার আর নদীর বিয়ে হয়”?

তখনি রিয়াদের মনের দ্বিতীয় সত্তা বলে উঠলো,

_”না রিয়াদ এটা হওয়ার নয়। সে যে তোকে চায় না। তার মুখের হাঁসি তুই নস, জয়”।

রিয়াদ নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,

_”কাকা আপনি আসলে ভুল ভাবছেন। আমি আমার নয় জয়ের সাথে নদীর বিয়ের কথা বলতে চাচ্ছি”।

নদীর আব্বা মুখশ্রীতে তিরস্কার ফুটে উঠলো। মনে হলো সে কথাটি শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। কিছুটা বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন,

_”এসব কি বলছো? তোমার দোকানের কর্মচারীর সাথে আমার মাইয়ার বিয়ার প্রস্তাব নিয়া আইছো তুমি”?

একটু থেমে পুনরায় বললেন,

_”দেখো তোমার ব্যবসায় অনেক নাম ডাক হইছে। অল্প বয়সেই ব্যবসায় উন্নতি করতেছো তুমি, তাই আমি তোমার লগে নদীর বিয়ার কথা ভাবতেছিলাম। তোমার দোকানে কাজ করা ঐ পোলার লগে আমি আমার মাইয়ার বিয়ার কথা সপনেও ভাবতে পারি না”।

রিয়াদ বিষ্ময় নিয়ে নদীর আব্বার মুখশ্রীতে তাকিয়ে আছে। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে নদী সব শুনতে পাচ্ছে। নদী বেশ অনেকক্ষন যাবত দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। রিয়াদের মুখশ্রী আপনা আপনিই দরজার আড়ালে দাঁড়ানো অসহয় নদীর মুখশ্রীর দিকে গেলো। নদীর মুখশ্রী দেখে মনে হচ্ছে যখন তখন সে কেঁদে দিবে। রিয়াদের মন বলে উঠলো,

_”তার কান্না আমার সহ্য না। একদম সহ্য না”।

রিয়াদ নদীর আব্বার উদ্দেশ্য বললো,

_”কাকা আমি না জয় মূলত ব্যবসাটার আসল মালিক। আমি ওর কর্মচারী”।

নদীর আব্বা বিষ্ময় নিয়ে বললেন,

_” এসব কি বলতেছো? সবাই জানে এটা তোমার বাবার জমি, সেখানে তুমি দোকান উঠাইছো”।

_” না কাকা। কথাটা সত্যি নয়। মূলত আমার আম্মা আমার পড়ালেখার জন্য জমিটা জয়ের আব্বার কাছে বিক্রি করেছে। জয় নিজেকে কর্মঠ তৈরি করতে পড়ালেখার পাশাপাশি ব্যবসা খুলে বসেছে। আমি ওর বন্ধু হওয়ায় ও আমাকে কাজে নিয়েছে”।

_”যদি এইটা সত্যি না হয়”?

_”সত্যি হইলে আপনি জয় আর নদীর বিয়ে দিবেন”?

_” সত্যি হইলে দিবো। বাপ হিসাবে আমি আমার মাইয়ায় যেখানে সুখে থাকবে সেখানেই বিয়া দিতে চাইবো”।

রিয়াদ একটা তাচ্ছিল্য হাঁসি দিয়ে বললো,

_”টাকা থাকলেই বুঝি মেয়েরা সাংসারিক জীবনে সুখী হয়”?

নদীর আব্বা কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলো। কথা কাটাতে তিনি বললেন,

_”কি প্রমান আছে ঐটা জয়ের দোকান”?

_” আপনি আমার আম্মারে জিজ্ঞেস করে দেখেন”।

_”আচ্ছা চলো এখনি তোমার আম্মারে গিয়া জিগাই”?

_”এখন”?

_”হ। ক্যান কোন সমস্যা ”?

_” কাকা কাল জিজ্ঞেস করলে হয় না”?

_”না কাল নয়। আজই জিগাবো এবং এখনি”।

_”কাকা আসলে….”।

_” আসলে নকলে বাদ। এখনি জিজ্ঞেস করবো। চলো”।

রিয়াদ বোকা বনে গেলো। রিয়াদের আম্মা তো জানে না এসব। তার আম্মারে এখন জিজ্ঞেস করলে তো সে সত্যিটা বলে দিবে তখন! নদীর আব্বা নাছোড়বান্দা তাই জোর করে রিয়াদকে নিয়ে তার বাড়ি চলে গেলো।

রিয়াদের হাত ধরে রিয়াদের আম্মার সামনে নিয়ে গেলো নদীর আব্বা। রিয়াদের আম্মা কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই নদীর আব্বা সোজাসুজিভাবে জিজ্ঞেস করলো,

_”রিয়াদ যে দোকানটা চালায় ঐটা কার”?

রিয়াদ ভয়ে নিজের চোখ বন্ধ করে নিলো। নদীর আব্বা প্রশ্নের উত্তর শোনার জন্য আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরপর রিয়াদের আম্মা যা বললো তার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলো না।

রিয়াদ চোখ মেলে বিষ্ময় নিয়ে তার আম্মার মুখশ্রীতে তাকালো।

পর্ব পাঁচ

রিয়াদের আম্মা বললো,

_”দোকানটা জয়ের”।

রিয়াদ বিষ্ময় নিয়ে তার আম্মার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার আম্মার দ্বিতীয় কথাটি শুনে সে আরো অবাক হলো। আম্মা বললো,

_”এটা মুখের নয় কাগজের কথা। রিয়াদের ঐ দোকানের উপর কোন অধিকার নাই। ঐ দোকান জয়ের”।

রিয়াদের আম্মার থেকে শুনে কিছু স্বস্তি পেলো নদীর আব্বা। তারপরো তিনি আলাদাভাবে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করবেন। নদীর আব্বা চলে যেতেই রিয়াদ তার আম্মারে বললো,

_”আম্মা তুমি জানলে কিভাবে দোকানটা জয়ের? কাগজে কলমে”?

আম্মা রিয়াদের মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন,

_”জয় তোর বন্ধু। বন্ধুর এক কথায় সব দাবি ছাইড়া দিলি বাজান। কাগজে লিখে দিলি যে ঐ জমি বা দোকানের উপর তুই কোন অধিকার ফলাবি না”?

_”আম্মা এসব তোমারে কে বললো”?

_”জয় বইলা গেছে। আইজ আমি সবজি নিয়ে আসতে যাওয়ার সময় বললো। কাগজটাও দেখাইছিলো”।

রিয়াদ অবাক নয়নে আম্মার দিকে তাকিয়ে রইলো। রিয়াদ কল্পনাও ভাবেনি জয় এসব তার আম্মাকে বলে দেবে।

হঠাৎ রিয়াদের স্মৃতিতে দু’দিন আগের কথা ভেঁসে উঠলো। সেদিন জয় রিয়াদের কাছে এসে বললো,

_”রিয়াদ আমি তোকে কিছু বলতে চাই”।

_”হ্যাঁ বল”।

_”আমার মনে হয় নদীর সাথে বোধহয় আমার মিল হবে না”।

_”মানে? হঠাৎ এরকম মনে হলো কেন”?

_”মেয়ের জামাই হিসাবে নদীর আব্বা নিশ্চয় তোর দোকানের কর্মচারীকে মেনে নিবে না”।

_”কর্মচারী মানে? তুই কর্মচারী হবি কেন? তোর আর আমার ভাগের দোকান এটা”।

_”এভাবে ভাগে ব্যবসা হয় না রিয়াদ। গ্রামের সবাই জানে এই ব্যবসাটা তোর। যে জমির উপর দোকানটা তৈরি সেই জমিটা তোর, দোকানটা তোর। এখানে আমি কর্মচারী ছাড়া কিছুই নই”।

রিয়াদ বলার মতো কোন ভাষা খুঁজে পেলো না। রিয়াদকে চুপ থাকতে দেখে জয় বললো,

_”এই ব্যবসাটা আমার নাহলে নদীকে আমার পাওয়া হবে না রে রিয়াদ”।

_”তুই আমাকে কি করতে বলছিস”?

_”শুধু লোককে দেখানোর উদ্দেশ্য তুই দোকানের উপর থেকে দাবি ছেড়ে দিয়ে এটা আমার বলে সবাইকে জানিয়ে দে। যাতে নদীর আব্বা আমাকে মালিক ভেবে নদীর সাথে আমার বিয়েটা দিয়ে দেয়”।

_”মানে তুই মালিকানা চাচ্ছিস”?

_” না মানে….”।

_”দিয়ে দিবো। শুধু আমাদের সংসার চালানোর খরচটা দিলেই হবে, বাকিটা তুই রাখিস”।

_”তারমানে তুই সত্যি আমাকে মালিকানা দিয়ে দিবি”?

_” হুম”।

_”তাহলে তুই এক কাজ কর কাগজে লিখে দে এই দোকানের উপর তোর কোন অধিকার নেই এটা আমার দোকান। কাগজে এটা লিখে সই করে দে”।

রিয়াদ জয়ের চোখের দিকে তাকালো। না এ চোখে লোভ ছিলো না। লোভের ভাষা এমন নয়! তবে কি সত্যি নদীকে পাওয়ার জন্যই মালিকানা চাচ্ছে জয়! রিয়াদ কিছু না ভেবেই সেদিন কাগজে ওটা লিখে দিয়েছিলো।

স্মৃতি থেকে বেরিয়ে রিয়াদের মন একটা কথাই বললো,

_”মালিকানা নদীর জন্য চাইলে, আম্মারে কেন বলে দিলো এসব? যাতে সবাই ওরে মালিক ভাবে তাই নাকি অন্য কোন কারনে”?

রিয়াদের আম্মার কথায় রিয়াদ হুশে ফিরলো। আম্মা বললো,

_”কিশোর বয়স এইটা। একজনরে ভালো লাগতেই পারে, তাই বইলা তার জন্য সবকিছু হারানোটা ঠিক না। তুই চাইলে জয়রে এখনো দোকানটা আত্মসাৎ করা থেইকা আটকাইতে পারো”।

_”আম্মা আমি কিছু বুঝলাম না”।

_”আমি তোর বিছানার নিচে লুকানো খাতাটা পড়ছি। ওহানে নদীর প্রতি তোর অনুভূতির কথা লেখা ছিলো”।

রিয়াদ চমকে আম্মার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারমানে তার আম্মা সবকিছু জেনে গেছে। রিয়াদ নিজের চোখের অশ্রুকে আটকে রেখে বললো,

_”আম্মা আমি তারে খুব ভালোবাসি”।

_”এটা আবেগ বাজান। এটা ভালোবাসা না”।

_”না আম্মা এটা আবেগ না। আর যদি আবেগ হইয়া থাকে তবুও আমি সেই আবেগেই হারিয়ে যেতে চাই। কিশোর বয়সের এই আবেগকে সারাজীবন হৃদয়ে বাইন্ধ রাখতে চাই”।

আম্মা শান্তভাবে বলল,

_”আমার কিছু বলার নাই বাজান। শুধু বলবো ভাইবা দেখিস জীবনটা নিয়া”।

আম্মা চলে গেলো। আম্মা হয়তো বুঝতে পেরেছে তার সন্তান বড় হয়ে যাচ্ছে। এখন নিজের সিদ্ধান্ত নিতে তার আম্মার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। এটা ভেবেই হয়তো অভিমানে চলে গেছে।

রিয়াদ মনেমনে ভাবছে,

_”আম্মার এই অভিমান ভাঙাবো কিভাবে”?

______

দু’দিন রিয়াদের আম্মা তার সাথে ভালোভাবে কথা বলেনি। রিয়াদ আর সহ্য করতে না পেরে আম্মার কাছে গিয়ে তারে জড়িয়ে ধরে বললো,

_”আম্মা রাগ করো আছো”?

_”না। আমি জানি আমার পোলা কোন ভুল করতে পারে না। তাও যার জন্য নিজের সব দিচ্ছিস সে তো তোর না”।

_”আম্মা সে আমার হলে যে, তার চোখেমুখে এখন যে খুশিটা রয়েছে তা আর থাকবে না”।

একটু থেমে পুনরায় বললো,

_”আমি যে তার কান্না সইতে পারি না”।

আম্মা রিয়াদের মুখশ্রীতে তাকিয়ে বললো,

_”এরম গভীর কথা তুই কই শিখলি বাজান? কেমনে শিখলি”?

_”জানি না আম্মা। তবে তার খুশিতেই আমি খুশি”।

আম্মা চুপ করে রইলেন। রিয়াদ একমনে বললো,

_”নাই বা হলো সে আমার। নাই বা জানলো আমার হৃদয়ের কথা। আমি তার খুশিময় মুখশ্রীতেই নিজের ভালোবাসার প্রাপ্তি খুঁজে পাই”।

আম্মা আর কিছু না বলে রিয়াদকে জড়িয়ে ধরলেন।

অন্যদিকে জয় এবং নদীর বিয়ে প্রায় পাকাপোক্ত৷ বিয়ের দিন তারিখও ঠিক করা হয়েছে। এর মধ্যে একদিন নদী জয়ের সাথে লুকিয়ে দেখা করলো৷

জয় নদীর কাছে এসে বললো,

_”প্রেয়সী হঠাৎ জরুরি তলোপ পাঠালে”?

_”আব্বারে মিথ্যা বলাটা কি ঠিক হইলো”?

_”মিথ্যা? কিসের মিথ্যা”?

_”এই যে ব্যবসাটা তোমার”?

_”ব্যবসা তো আমারি”।

_”মানে? ওটা তো রিয়াদের ব্যবসা, তোমাকে তো ও বন্ধু হিসাবে সাথে নিয়েছে”।

_”তোমার আর আমার মিল করাতে রিয়াদ ব্যবসাটা আমায় দিয়ে দিয়েছে”।

_”কি”?

নদী অবাক হয়ে গেলো। জয় বললো,

_”তোমার আব্বা যাতে আমাদের সম্পর্ক মেনে নেয় তাই ও ব্যবসাটা আমায় দিয়ে দিয়েছে”।

নদীর বিষ্ময় আরো বেড়ে গেলো। রিয়াদ তার বন্ধু ঠিক। রিয়াদ তার কথা রাখে সবসময়, তাই বলে তাদের মিল করাতে নিজের ব্যবসা দিয়ে দিলো। কিন্তু কেন! মহানুভবতা থেকে নাকি অন্য কিছু!

জীবনে প্রথমবার নদীর রিয়াদের ব্যবহারে সন্দেহ হচ্ছে। খুব সন্দেহ হচ্ছে।

নদীর বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। কাল গায়ে হলুদ, পরশু বিয়ে। সবাই বিয়ে নিয়ে খুব ব্যস্ত। এই ব্যস্ততার মাঝে নদীর সন্দেহটা শেষ হয়ে গেলো।

নদীর সন্দেহটা পুনরায় জেগে উঠলো যখন গায়ে হলুদে রিয়াদের দেখা পেলো না তখন। রিয়াদের আম্মা আসলেও রিয়াদ আসেনি। তবে বিয়ের দিন রিয়াদ ঠিকই এসেছিলো। নদীকে বধু সাজানো শেষ হওয়ার একটু আগে এসেছে রিয়াদ। হাতে করে নিয়ে এসেছে গাঁদা ফুলের মালা। নদীকে সাজানো মেয়েগুলোর হাতে মালাটা দিয়ে বললো,

_”এটা ওর খোঁপায় গেঁথে দিবেন”।

বঁধু বেসে বসে আছে নদী। মাথার খোঁপায় রিয়াদের দেওয়া গাঁদা ফুলের মালা। নদীর দু’চোখে আজকের এই দিনটাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন। তাই রিয়াদের কথা ভুলে গেছে সে। নদীর চোখের পাতায় এখন শুধু একটা মানুষই ভেঁসে বেড়াচ্ছে। সে হলো ‘জয়’ ‘জয়’ আর ‘জয়’।

বিয়ে শেষে বিদায় নিয়ে পালকি করে চলে যাচ্ছে নদী। রিয়াদ আড়ালে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখে চোখের অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। নদীর চলে যাওয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রিয়াদ বললো,

_”ভালো থেকো প্রিয়তমা। আমার বুকের মধ্যে #অচেনা_প্রেম হয়ে আর জয়ের ভালোবাসার পূর্ণতা হয়ে”।

পাগল মন পুনরায় আক্ষেপ করে বলে উঠলো,

_” আমি হয়তো বিশাল নদীর ঢেউয়ের সামনে পড়ে থাকা বালুর বাঁধ। যে বাঁধ ঢেউয়ের আড়ালে হারিয়ে যায়”।

৬ বছর পর,

অনেকদিন পর গ্রামে ফিরে রিয়াদ বেশ অবাক হলো। গ্রামের লোকজন তার দিকে কেমন দৃষ্টিতে জানে তাকাচ্ছে! প্রবীনরা যারা রিয়াদকে চেনে, তারা নবিনদের কানে কানে কিছু একটা বলছে।

রিয়াদ তাদের দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে গেলো। মাঝরাস্তায় দেখা হলো রহিম কাকার সাথে। স্কুল শেষে রহিম কাকার সাথে কতই না গল্প করতো তারা। রিয়াদ রহিম কাকাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,

_”কেমন আছো কাকা”?

_”কে”?

রহিম কাকা রিয়াদকে ভালোভাবে লক্ষ্য করে বললো,

_” রিয়াদ”?

_”হ্যাঁ কাকা আমি রিয়াদ”?

_”তুই গ্রামে ফিরা আইছে ক্যান? আমাগো গ্রামের মান-সম্মান ডুবাইয়া কোন মুখে ফেরত আসছোস”?

রহিমা কাকা বেশ বিক্ষোভ নিয়ে বললেন কথাগুলো। রিয়াদ কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,

_”মানে”?

রহিম কাকা রিয়াদের কথা পাত্তা না দিয়ে বললো,

_”তা সেই কাল নাগিনী কই? জয়কে তো পাগল বানিয়ে গেলো, বলি তোর সাথে আবার কি করলো? দেখছি না যে”?

_” আমি কিছু বুঝতে পারছি না কাকা”?

_”তা বুঝবেন কেন? যখন নদীরে নিয়া ভাগছিলি তখন বুঝছিলি এর জন্য জয় বাবাজির সাথে কি হইতে পারে”?

রিয়াদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। কানে বার বার একটা কথাই বাজছে,

_”নদীরে যখন ভাগাইয়া নিছিলি”।

পর্ব ছয়

গ্রামে ঢোকার পর রিয়াদের মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়। সবাই বলছিলো, “নদী তোমাকেও ছেড়ে গেছে”।

রিয়াদ কিছু বুঝতে পারছে না। কেউ তাকে পরিষ্কার ভাবে বলতে চাইছে না। সবার দৃষ্টিতে তার জন্য ঘৃনা দেখতে পাচ্ছে সে! লোকমুখে যতটুকু শুনেছে তাতে বুঝতে পেরেছে নদী জয়ের সাথে নেই। আর জয়ের অবস্থাও ভালো নয়। রিয়াদ কোনকিছু না ভেবে পেয়ে জয়ের বাড়ি চলে গেলো।

জয়ের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রিয়াদ বেশ অবাক হলো। পূর্বের টিনের ঘরটি এখন ইট পাথরে রুপান্তির হয়ে গেছে। জয় ব্যবসা করে যে উন্নতির দৌড় গড়ায় পৌঁছে গেছে তা রিয়াদ ভালোই বুঝতে পারলো। রিয়াদ কিছুটা সংকোচ নিয়েই জয়ের দরজায় কড়া নাড়লো।

দরজার ওপারে রিয়াদের জন্য দ্বিতীয় চমক অপেক্ষা করছিলো। দরজা খুলে দেওয়ার ব্যক্তিটিকে দেখে রিয়াদ বেশ অবাক হলেও, ব্যপারটা স্বাভাবিকভাবে নিলো। দরজার ওপারে স্বপ্না দাঁড়িয়ে আছে। স্বপ্না শান্তভাবে বললো,

_”কি চাই”?

_” কি চাই মানে, আমি জয়ের সাথে দেখা করতে এসেছি”।

_”জয়ের সাথে তোর প্রয়োজন তো ফুরিয়ে গেছে। তা দেখা করতে কেন চাচ্ছিস”?

_”জয়ের সাথে আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে মানে? গ্রামের লোকজন বাহিরে এসব কি বলছে? আমি কিছু বুঝতে পারছি না”।

_”এখন তো তুই বুঝবিও না। জয়ের জীবনটা নষ্ট করতে চেয়েছিলি, যখন দেখলি সফল হতে পারিসনি তখনি ফিরে এসেছিস”।

_”তুই এসব কি বলছিস স্বপ্না”?

_”আমি কিছু বলতে চাচ্ছি না। আমি চাচ্ছি তুই এই মূহুর্তে এখান থেকে বেরিয়ে যাবি”।

রিয়াদ বিষ্ময়ে মুখশ্রী হা হয়ে গেলো। স্বপ্নার কথাকে পাত্তা না দিয়ে রিয়াদ বললো,

_”আমি জয়ের বাড়িতে এসেছি, জয়ের সাথে দেখা করে তারপর যাবো”।

_”জয় বাড়িতে নেই আর থাকলেও তোর সাথে দেখা করতো না”।

_”তাহলে কাকিমার সাথে কথা বলবো”।

_”তোর এই ঘৃনিত মুখ আমার শাশুড়ী আম্মা দেখতে চাইবেন না”।

রিয়াদের অবাক হওয়া বোধহয় আরো বাকি ছিলো, তাই তো একটার পর একটা বিষ্ময়কর কথা শুনতে হচ্ছে। রিয়াদের জানা মতে জয় এবং তার বোন ছাড়া তাদের আর কোন ভাই নেই। তাহলে জয়ের আম্মাকে স্বপ্না শাশুড়ী বললো কেন! রিয়াদ কৌতুহল নিয়ে বললো,

_”শাশুড়ি আম্মা মানে”?

_”কেন কি ভাবছিলি তোরা, নদীর বিরহে জয় নিঃশেষ হয়ে যাবে? জয়ের জীবনে কেউ আসবে না কখনো”?

একটু থেমে পুনরায় বললো,

_”তাহলে তুই ভুল ভেবেছিস। নদীর বিরহে জয়কে আমি শেষ হতে দেইনি। জয়কে আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে সাঁজিয়ে দিয়েছি”।

_”স্বপ্না আমি সত্যি কিছু বুঝতে পারছি না”।

স্বপ্না রিয়াদের চোখের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। সাথে সাথে নিজের চোখ বন্ধ করে ফেললো স্বপ্না। এই চোখের দিকে তাকিয়ে নতুন কোন স্বপ্ন দেখতে চায় না স্বপ্না। স্বপ্না স্বপ্নগুলো তো সেদিনই শেষ হয়ে গেছিলো যেদিন রিয়াদ বলেছিলো, সে স্বপ্নাকে নয় নদীকে ভালোবাসে।

স্বপ্না মনেমনে কিছু একটা ভেবে রিয়াদের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো।

রিয়াদের হতাশ হওয়া ছাড়া এই মূহুর্তে কিছুই করার নেই। রিয়াদ একমনে হেঁটে বাড়ি চলে এলো। বহুদিন পর প্রায় ছয়’বছর পর বাড়ি ফিরলো সে। মনে হচ্ছে জানো কতটা সময় পার হয়ে গেছে।

আম্মার সাথে কাটানো মধুর স্মৃতিগুলো স্মরণ করতে করতে রিয়াদ ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলো।

রিয়াদের আসার খবর পেয়ে নদীর বোন নুপুর তাদের বাসায় ছুটি আসলো। উঠান থেকেই রিয়াদকে ডাকতে লাগলো,

_”রিয়াদ ভাইয়া”।

রিয়াদ নুপুরের ডাক শুনে বাহিরে চলে এলো। নুপুর রিয়াদকে সামনে দেখে খুব দ্রুত জিজ্ঞেস করলো,

_”আমার আপা কই ভাইয়া”?

রিয়াদ চমকালো না। রিয়াদ এতক্ষনে এতটুকু বুঝে গেছে, নদীর সাথে তাকে জড়িয়ে এখানে কিছু রটেছে। রিয়াদ স্বাভাবিক ভাবে বললো,

_”ভিতরে চলো নদী, তোমার সাথে আমার কথা আছে”।

_”আমারো কথা আছে”।

_”আচ্ছা চলো”।

রিয়াদ নুপুরকে নিয়ে ভিতরে গেলো। ভিতরে গিয়ে খুব শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলো,

_”আমি এখানে না থাকায় কি কি ঘটেছে নুপুর? নদী আমার কাছে আছে এসব তোমাকে কে বলেছে”?

_”আপা যে তোমার কাছে গেছে এটা তো সবাই জানে”।

_”সেটাই তো জানতে চাই, কিভাবে জানে সবাই”?

_”আচ্ছা শোন বলছি,

নুপুর বলতে শুরু করলো। দুই বছর আগে একদিন হঠাৎ শোনা গেলো নদী শুশুড় বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে। আব্বা, আম্মা সেটা শুনে সাথে সাথে জয় ভাইয়াদের বাড়ি গেলো। বাড়ি গিয়ে দেখতে পেলাম, জয় ভাইয়া পাগলের মতো কান্না করছে। মুখ দিয়ে শুধু একটা কথাই বলছে,

_”আমার নদী। আমি আমার নদীরে ছাড়া বাঁচবো না, কোথায় নদী, ফিরে এসো”।

সেদিন জয় ভাইয়া পুরো পাগলের মতো কান্না করছিলো। আমরা যেতেই জয়ের আম্মা আমাদের হাতে একটা চিঠি তুলে দেয়। চিঠিটা নদীর আপার লেখা। চিঠিতে লেখা ছিলো,

প্রিয় জয়,

আমি উপলব্ধি করতে পারছি আমি তোমাকে ভালোবাসি না। আমি যারে ভালোবাসি সেই মানুষটা তুমি নও। আমার ভালোবাসার মানুষটা রিয়াদ। আমি রিয়াদকে ছাড়া নিঃস্ব।

চার বছরের সংসার জীবনে এই কথাটি বারবার বলতে চেয়েছি তোমাকে, কিন্তু তুমি শুনতে চাওনি। আর যাই হোক একজন অক্ষম পুরুষের সাথে সম্পর্ক রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি খুব ভালো করে জানো, তুমি কখনো বাবা হতে পারবে না৷

আমি তোমার সাথে থেকে মাতৃত্বের সাধ থেকে বঞ্চিত হতে পারবো না। তাই আমি রিয়াদের সাথে সম্পর্কে জড়াই। আমি এখন একমাসের গর্ভবতী। আমি গর্ভবতী শোনার পর, তুমি হয়তো বুঝতে পারতে আমি আর তোমার নেই। তাই নিজ থেকে জানিয়ে চলে যাচ্ছি।

ভালো থেকো তুমি।

ইতি নদী

সব শুনে রিয়াদ স্তব্ধ হয়ে বসে পড়লো। অস্পষ্টসুরে মুখ দিয়ে বের করলো,

_”আমি বিশ্বাস করি না”।

বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কঠিন গলায় বললো,

_”নদীর সাথে কিছু হয়েছে। ঐ চিঠি নদীর লেখা কিছুতেই হতে পারে না। কিছুতেই নয়। যেখানে প্রায় ছয় বছর ধরে আমাদের মধ্যে কোন কথাই হয়নি সেখানে নদী আমার জন্য বাড়ি ছেড়েছে, এটা সত্যি হতেই পারে না”।

নুপুর বিষ্ময় নিয়ে বললো,

_”তারমানে আপা তোমার কাছে যায়নি। তাহলে আমার আপা কোথায়”?

রিয়াদ নিরবতা নিয়ে নুপুরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই মূহুর্তে নুপুরকে বলার মতো কোন বাক্য তার কাছে নেই।

নুপুর সন্দেহভরা দৃষ্টি নিয়ে বললো,

_”তুমি আমার আপার সাথে কিছু করো নাই তো? এখন না জানার ভান ধরছো”।

রিয়াদ মলিন হেঁসে নুপুরের মাথায় হাত রাখলো। মায়াভরা কন্ঠে বললো,

_”আমি তোমার আপারে খুঁজে বের করবো। তুমি মানো বা না মানো আমি তোমার আপাকে গত ছয় বছর চোখের দেখাও দেখিনি”।

‌_”তুমি সত্যি আপার সাথে ছিলে না”।

_”সমাজের মানুষ তোমার আপারে কলঙ্ক দিচ্ছে। আচ্ছা তুমি বলো তোমার আপা কলঙ্কিত হওয়ার মতো মানুষ”।

একটু থেমে পুনরায় বললো,

_”নদী খুব স্বচ্ছ, পরিষ্কার হয়। তার গায়ে কলঙ্কের দাগ লাগাটা বড্ড বেমানান”।

_”তোমার এই কঠিন কথা আমি বুঝতে পারছি না। আমি শুধু জানতে চাই, তুমি আমার আপারে সত্যি খুঁজে বের করবা”।

_”সত্যি খুঁজবো”।

_”কবে”?

_”খুব তাড়াতাড়ি”।

_”আমি কিন্তু তোমাকে বিশ্বাস করছি না এখনো”।

_”তোমার আপারে খুঁজে এনে, আমি তোমার বিশ্বাস অর্জন করে নিবো”।

নুপুর কিছু না বলে চলে গেলো। রিয়াদের কথায় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে, সে নদীকে খুঁজে দিবে। পরক্ষণেই অন্য মন বলছে, এই তো আপারে নিয়া গেছে। এ জানে আপার ঠিকানা, নতুন করে কি খুঁজবে! নুপুর ভেবে পাচ্ছে না কি করবে! আজ সে দশম শ্রেণিতে পড়া একজন কিশোরী। জীবনের বাস্তবতা অনুভব করতে শিখেছে সে। বাস্তবতার পাশাপাশি, আবেগ, ভালোবাসাও উপলব্ধি করছে সে। ভালোবাসা উপলব্ধি করার ক্ষমতা আছে বলেই সে নদীর বিয়ের দিনে রিয়াদ আর স্বপ্নার কথার মানে বুঝতে পারছে। সেদিন ছোট থাকায় ততটা বুঝতে পারেনি বলে আজ বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না।

নুপুর স্মৃতির পাতায় নদীর বিয়ের দিনে স্বপ্না আর রিয়াদের কথাগুলো স্মরণ করতে লাগলো।

সেদিন নদীর বিদায়ের পালা শেষে স্বপ্না রিয়াদের কাছে এলো। রিয়াদ আড়ালে দাঁড়িয়ে চোখের অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিলো, ঠিক সেসময় স্বপ্না এসে বললো,

_”তুই কাঁদছিস কেন রিয়াদ? জয়ের বিয়ে হয়ে গেলো অথচ তোর হচ্ছে না তাই”?

রিয়াদ চমকে স্বপ্নার দিকে তাকালো। স্বপ্না পুনরায় বললো,

_”আমি তো রাজিই আছি, চল দু’জনে বিয়ে করে ফেলি”।

রিয়াদ নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,

_”কি সব আবোল-তাবোল বলছিস এসব”?

_”আবোল-তাবোল মানে? আমার কি বিয়ের বয়স হয়নি”?

_”হ্যাঁ হয়েছে কিন্তু তাতে আমার কি”?

_”তোর কি মানে? আমরা একে-অপরকে ভালোবাসি তাই…..”।

রিয়াদ স্বপ্নার কথা সমাপ্ত করার পূর্বেই বললো,

_”আমরা একে-অপরকে ভালোবাসি মানে? কি ভুলভাল বকছিস তুই”?

_”ভুলভাল বকছি মানে”?

_”আমি তোকে কখন বললাম যে তোকে আমি ভালোবাসি”?

রিয়াদের কথায় স্বপ্নার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। এতদিন তিলে তিলে যে স্বপ্ন স্বপ্না নিজের মনে গড়ে তুলেছিলো তা ভুল ছিলো। স্বপ্না নিজেকে সংযত করে বললো,

_”মুখে না বললেও আকারে ইঙ্গিতে তো ভালোবাসা বুঝিয়েছিস তুই”?

রিয়াদ হতভম্ব হয়ে গেলো।

_”মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর? আমি আকারে ইঙ্গিতে তোকে ভালোবাসি বুঝিয়েছি”?

_”হ্যাঁ বুঝিয়েছিস। একবার নয় বারবার, হাজার বার”।

স্বপ্নার চিৎকার করে বলা উপরোক্ত বাক্যটি রিয়াদকে নিস্তব্ধ করে দিলো।

পর্ব সাত

_”একবার নয় বারবার, হাজার বার ইঙ্গিত দিয়েছিস৷ ভালোবাসাটা তোর জন্যই এত গভীর হয়েছে”।

রিয়াদ বিষ্ময়ে হা হয়ে গেলো। বিষ্ময় নিয়েই বললো,

_”কেমন ইঙ্গিত? আর কখনই বা ইঙ্গিত দিয়েছিলাম”?

স্বপ্না চোখের অশ্রু বিসর্জন দিয়ে শান্তভাবে বললো,

_”যখন আমার কিশোরী মন আবেগের হাওয়া ভেসে চলেছিলো, ঠিক তখনি। আমি নদী যখন স্কুল মাঠে নানা ধরনের গল্প মগ্ন থাকতাম, ঠিক তখন তোর প্রেমময় দৃষ্টি আমাকে ইঙ্গিত দিয়েছিলো ভালোবাসার। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে তোর অবাধ্য চোখ যতবার আমার দিকে তাকিয়েছে ঠিক ততবার ভালোবাসার ইঙ্গিত দিয়ে গেছে”।

রিয়াদের বলার মতো কোন ভাষাই রইলো না। প্রেমময় দৃষ্টি যার দিকে নিক্ষেপ করেছিলো, সেই মানুষটাই কখনো বুঝলো না, অথচ অন্য একজন সেই দৃষ্টিতে নিজেকে স্বপ্নের দুনিয়ায় রাঙিয়েছে। রিয়াদের এই মূহুর্তে চুপ করে থাকাটা ঠিক নয়, এখন চুপ থাকলে ভুল হয়ে যাবে। তাই রিয়াদ বললো,

_”আমি তোর দিকে কখনো ওভাবে তাকাইনি স্বপ্না। তুই আর নদী একসাথে থাকায়, কখনো বুঝতে পারিসনি আমি তোর নয় নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতাম”।

রিয়াদের কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরে স্বপ্না বিষ্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কাপা কাপা কন্ঠে বললো,

_”তুই নদীকে……”।

_”হ্যাঁ। আমার চাহনিতে যে ভালোবাসা ছিলো, সেটা তোর জন্য নয় নদীর জন্য ছিলো”।

স্বপ্নের পৃথিবী যেখানে থমকে গেছে।

এরপর কি হয়েছে তা নুপুরের জানা নেই! কেননা সেদিন রিয়াদ স্বপ্নাকে আর সুযোগ না দিয়ে চলে গেছিলো! নুপুর যখন বুঝতে শিখেছি তখন তার মন বলেছে,

_”রিয়াদ নদীকে ভালোবাসতো তাহলে নদীর তার কাছে যাওয়ার ঘটনাটা হয়তো সত্যি”।

তাই তো আজ রিয়াদের কথাগুলো বিশ্বাস করতে তার কষ্ট হচ্ছে।

অন্যদিকে রিয়াদ ভেবে পাচ্ছে না তার সাথে কি হচ্ছে! কেনই বা নদী পালিয়ে গেলো! পালিয়ে গেলো তো গেলো। কিন্তু কোথায়? ঐ চিঠিটার অর্থ কি! চিঠিটা কে লিখল এবং কেন?

রিয়াদের মনে হচ্ছে নদী খুব বিপদে আছে। হয়তো সেই বিপদটা নদীর গায়ে লাগা কলঙ্কে ঢাকা পড়ে গেছে।

রিয়াদ পরেরদিন সকালবেলা জয়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো। একদিন এখানে একটি দোকান দিয়ে কাজ শুরু করেছিলো রিয়াদরা, আজ এখানে পরপার চারটা দোকান। পাঁচজন কর্মচারী। তাদের থেকেই জানা সবগুলো জয়ের দোকান। জয় জীবনে উন্নতির শিখরে পৌঁছে গেছে। আজ আর জয়ের জীবনে রিয়াদের প্রয়োজনীয়তা নেই। ফুরিয়ে গেছে সব প্রয়োজন।

কর্মচারীর থেকে জানা গেলো জয় কিছুক্ষনের মধ্যে এখানে আসবে। তাই রিয়াদ অপেক্ষা করছে।

বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষার শেষে জয়ের দেখা মিললো।

জয় রিয়াদকে দেখে বেশ চমকালো। জয়ের বিষ্ময়কর চাহনি রিয়াদের চোখের আড়াল হলো না। জয় শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলো,

_”কি চাই”?

_”জয় আমার তোর সাথে কিছু কথা আছে। প্লীজ চল একটু আলাদা কথা বলি”।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও জয় যেতে রাজি হলো। রিয়াদ জয়ের সাথে একটা নিরিবিলি স্থানে গিয়ে বসলো। জয় স্বাভাবিক ভাবে বললো,

_”যা বলার তাড়াতাড়ি বল”।

_”নদীর সাথে কি হয়েছে”?

_”নাটক করার জন্য এত বছর পর দেখা করতে আসলি”।

রিয়াদ বুঝতে পারছে জয় এরকম কেন করছে! তাই নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললো,

_”নদীর সাথে আমার ছয় বছর দেখা হয়নি জয়। নদীর সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক ছয় বছর আগেও ছিলো না, আজও নেই। তোরা যা জানিস সব ভুল”।

জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

_”আমি অক্ষম কিনা জানি না, তবে সংসার জীবনের চার বছরে নদীকে একটা বাচ্চা দিতে পারিনি। হয়তো এটাকে সে আমার অক্ষমতা ভেবে নিয়েছে। সে তোর সাথে ভালো থাকা খুঁজে নিয়েছে তাই আমার কোন অভিযোগ নেই। তুই আমার বন্ধু, তোর জন্যই আজ আমি এতটা পথ পাড়ি দিতে পেরেছি। তাই আমার ভালোবাসা তোর সাথে সুখী, এটা জেনে আমি খুব খুশি আছি রিয়াদ”।

একটু থেমে পুনরায় বললো,

_”একবার মনে হয়েছিলো হয়তো জীবনে সামনে এগিয়ে যাওয়া আর হলো না। আমার ধারনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে স্বপ্না আমার হাত ধরেছিলো। স্বপ্নার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরেই আমি অতিতকে ভুলে গেছি রিয়াদ। তাই দয়া করে নতুন কোন নাটক করিস না”।

রিয়াদ বুঝতে পারছে না সে জয়কে কিভাবে বোঝাবে! কিন্তু তাকে যে বোঝাতেই হবে। রিয়াদ বললো,

_”তোরা যা জানিস তা ভুল। সত্যি আমাদের মাঝে কোন কিছু নেই। আমি আদো জানি না নদী কোথায়! আমি নদীকে খুঁজতে চাই জয়”।

জয় রিয়াদের মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে রইলো৷ খুব আস্তে করে বললো,

_”মানুষ এত নিখুঁত অভিনয় করে কিভাবে? দেখ তোর মুখশ্রী দেখে মনে হচ্ছে, তুই সত্যি বলছিস। আমার তোর কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে রিয়াদ”।

_”আমি অভিনয় করছি না জয়”।

_”তুই অভিনয় কর কিংবা না কর তাতে আমার কোন সমস্যা নাই। তোকে শুধু এটুকুই বলতে চাই, একজন হৃদয় ভাঙা মানুষ আর একজন হৃদয় ভাঙা মানুষকে বুঝতে পারে।

স্বপ্না হৃদয় ভাঙা ছিলো বলে আমার ভাঙা হৃদয়ের যন্ত্রনা উপলব্ধি করতে পেরেছে। আমি দ্বিতীয়বার স্বপ্নার হৃদয়টা ভাঙতে পারবো না। কিছুতেই না”।

রিয়াদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জয় চলে গেলো। রিয়াদ জয়ের চলে যাওয়ার দিকে দৃষ্টি দিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

রিয়াদের ভাবনাগুলো সব নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। রিয়াদ ভেবে পাচ্ছে না তার কি করা উচিত! কোথা থেকে শুরু করলে, সে নদীকে খুঁজে পাবে!

গ্রামের লোকজনের সাথে কথা বলে রিয়াদ নদীর ব্যপারে জানার চেষ্টা করলো, কিন্তু সফল হলো না। যতটুকু রটেছে ততটুকুই জানে তারা। কেউ বাড়তি কোন খবর দিতে পারলো না।

রিয়াদের মনে হচ্ছে আর কোন রাস্তা নেই! হয়তো নদীকে খুঁজে পাওয়ার সমস্যা রাস্তাই বন্ধ। কোথাও এক ফোঁটা আসা বেঁচে নেই। ঠিক তখনি আসার আলো নিয়ে পাশের বাসার জমিলা ভাবী বললেন,

_”দেখো আমরা যতটা জানি তা তো বললামই তবে…..”।

_”তবে কি ভাবী”?

_”নদীর পালানোর খবর বের হওয়ার কিছুদিন আগে রিতু(জয়ের বোন) এসেছিল তোমার খোঁজ নিতে”।

রিয়াদ কিছুটা নয় বেশ অবাক হলো। জয়ের বোন তার সাথে দেখা করতে এসেছিলো, কিন্তু কেন! রিয়াদ কৌতুহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,

_”রিতু কেন এসেছিলো”?

_”তা বলেনি, শুধু বলেছিলো তোমার সাথে দেখা হওয়াটা জরুরি”।

রিয়াদ তাদেরকে বিদায় দিয়ে ঘরে এলো। মনের মধ্যে কিছুটা আসা জাগলো, হয়তো রিতু তাকে কিছুটা সাহায্য করতে পারে। কিন্তু সে রিতু অব্দি পৌঁছাবে কিভাবে!

রিয়াদ বসে বসে ভাবছিলো ঠিক কিভাবে রিতুর সাথে দেখা করা যায়। ঠিক তখনি তাকে অবাক করে দিয়ে রিতু তার ঘরে ডুকে এলো। ঘরে প্রবেশ করার সময় দরজা দেয়নি রিয়াদ। তাই রিতু সোজাসুজি ভিতরে ডুকে গেলো। রিয়াদ রিতুকে দেখে বললো,

_”তুমি”?

_”হ্যাঁ আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই”।

_”হ্যাঁ বলো”।

_”দেখুন আমার হাতে সময় নেই, আমি কোন ঝামেলা চাই না। তাই সোজাসুজি বলে দিচ্ছি, ভাবী শহরে তার মামাতো বোনের বাসায় আছে। দয়া করে এসব নিয়ে গ্রামে আর কাটাছিড়া করবেন না”।

রিতু এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে চলে গেলো। ঠিক যে গতিতে রিয়াদের কাছে এসেছিলো, সেই গতিতেই চলে গেলো।

রিয়াদ রিতুর যাওয়ার পানে তাকিয়ে হা হয়ে রইলো।

রিতু শুধু চলে যায়নি, চলে যাওয়ার পূর্বে একটা কাগজ ঘরের ভিতর ফেলে গেলো। রিয়াদ কিছুক্ষণ কাগজটির দিকে তাকিয়ে রইলো।

রিয়াদ কাগজটি হাতে নিয়ে তার ভাঁজ খুললো। কাগজটিতে যা লেখা ছিলো তা পড়ে রিয়াদ দাঁড়ানো থেকে বসে পড়লো।

কাগজটিতে লেখা ছিল,

”তুই কোথায় রিয়াদ? এভাবে আমাকে একা ফেলে কোথায় চলে গেলি? তুই তো জানিস রিয়াদ, আমি তোর সাথে সবকিছু শেয়ার না করে থাকতে পারি না। তুই আমার একমাত্র বন্ধু, যার সাথে আমি মন খুলে কথা বলতে পারি। কেন এভাবে না বলে হারিয়ে গেলি? আমি যে একা হয়ে গেছি।

তুই যদি জানতি, আজ তোকে ঠিক কতটা প্রয়োজন আমার। তাহলে এভাবে একা ফেলে হারিয়ে যে’তি না।

ফিরে আয় রিয়াদ। আমার তোকে অনেককিছু বলার আছে রিয়াদ। ফিরে আয় না”।

রিয়াদ লেখাগুলো বারবার বললো। কল্পনায় নদীর কাতরসুরে তাকে ফিরে আসার আহ্বান প্রতিচ্ছবিরুপে ভেঁসে উঠলো। রিয়াদের মন বলছে নদী তাকে খুব কষ্ট নিয়ে ডেকেছে। নদীর অনেক কষ্ট হয়েছিলো।

কিন্তু রিয়াদ যখন চলে গিয়েছিলো, তখন তো নদী খুব ভালো ছিলো। নদী ভালো আছে বলেই তো সে চলে গিয়েছিলো।

রিয়াদের স্মৃতির পাতায় ছয় বছর আগের গল্পটা ভেঁসে উঠলো। নদীর বিয়ের দু’মা পর রিয়াদের কাছে নদীর একটা চিঠি আসলো। চিঠিতে লেখা ছিলো,

প্রিয় রিয়াদ,

আমি খুব খুশি আছি। জীবনে এত সুখী হবো তা কখনো ভাবিনি। জয় আমাকে এতটা ভালোবাসা দিয়েছে, যে জীবনের কিছু মূহুর্তের জন্মানো আবেগটা আজ বড্ড ভুল মনে হচ্ছে।

তোকে হয়তো খুব বিরক্ত করি। বিশ্বাস কর আমি অনেকবার চেষ্টা করেছে তোকে বিরক্ত না করতে। কিন্তু পারিনি। তোর সাথে শেয়ার না করতে পারলে আমার কেমন জানো লাগে। একটুও ভালো লাগে না। তাই আনন্দ এবং দুঃখ দুটোই তোর সাথে ভাগ করে নিচ্ছি।

আমি খুব সুখী। ভালোবাসায় গড়া আমার সংসারটা।

ইতি নদী

রিয়াদ যখন চিঠিটা পড়ে কান্না করছিলো, ঠিক তখন তার আম্মা বললো,

_”চল বাজান আমার শহরে যাই। তোর মামাকে দেখি না কতকাল হইলো”।

রিয়াদ সেদিন বুঝেও না বোঝার ভান ধরেছিলো। রিয়াদ জানতো তার আম্মা তাকে অন্য পরিবেশে নিয়ে গিয়ে নদীর স্মৃতি ভোলাতে চাচ্ছে। তবুও না বোঝার ভান ধরে আম্মার ইচ্ছে রাখতে মামার বাড়ি গেলো। রিয়াদের ভাষ্যমতে সেখানে কিছুদিন বেরিয়ে ফিরে আসবে। কিন্তু তা আর হলো না। সেখানে যাওয়ার কিছুদিন পর তার আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়লো। সাধারণ জ্বর ভেবে রিয়াদের আম্মা হেলায় হেলিয়ে দিয়েছিলো তার অসুস্থতাকে। রিয়াদ তার আম্মাকে বারবার বলা শেষেও সে হাসপাতালে যেতে রাজি হয়নি।

পরিশেষে আম্মার মৃত্যুটাকে উপহার হিসাবে পেয়েছিলো। সেদিনের পর থেকে রিয়াদ নিরব হয়ে গেছিলো। বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা যে ছিলো, সেই মানুষটাও আর রইলো না। নিজেকে সবকিছু থেকে কেমন জানো গুটিয়ে নিয়েছিলো রিয়াদ! সবকিছুর জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগলো তার। এরপর কয়েকটা বছর কিভাবে কেটেছে তা শুধু সেই জানে!

হঠাৎ কোন এক পড়ন্ত বিকেলে মনে হয়েছিলো, গ্রামে এসে একবার চেনা মানুষগুলো মুখশ্রী দেখে যাবে। কিন্তু গ্রামে এসে যা হলো।

পর্ব আট

নুপুরের সাহায্যে তার মামাতো বোনের বাসার ঠিকানা নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলো রিয়াদ। দরজায় কড়া নাড়ার কিছু মূহুর্তের মধ্যেই দরজা খুলে দিয়ে রাইসা(নদীর মামাতো বোন) সামনে এসে দাঁড়ালো। স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

_”কি চাই”?

_”নদী আছে”?

রিয়াদের নিঃসংকোচ বাক্যে রাইসা কিছু একটা ভাবলো। রাইসা পুনরায় স্বাভাবিকভাবে বললো,

_”রিয়াদ”?

রিয়াদ কিছুটা চমকালো। নদীর বোন তাকে কিভাবে চিনে? প্রশ্নটা মাথায় আসলেও সেটাকে মাথা থেকে বের করে দিয়ে বললো,

_”হ্যাঁ”।

_”ভিতরে আসুন”।

রিয়াদ রাইসার আহ্বান পেয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। ঘরের ভিতরে দুটো রুম দেখতে পেলো রিয়াদ। রিয়াদ চোখ দিয়ে আশেপাশটা ভালোভাবে লক্ষ্য করছিলো, কিন্তু নদীর দেখা পেলো না। পাশের ঘরটির দরজা চাপানো, তাই ভিতরে কি আছে সেটা দেখা যাচ্ছে না! রিয়াদের মন কোথাও না কোথাও আসা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, হয়তো ও ঘরে নদী আছে। রাইসা রিয়াদকে বসতে বলে ও ঘরে চলে গেলো। একটুপর হাতে একটা দিনপঞ্জি নিয়ে ফেরত এলো। দিনপঞ্জি রিয়াদের হাতে দিয়ে বললো,

_”এটা পড়ো, পরে বাকিটা বলছি”।

রিয়াদ দিনপঞ্জিটা হাতে নিয়ে বেশ অবাক হলো। হঠাৎ ও ঘর থেকে বাচ্চার কান্নার শব্দ ভেঁসে আসলো। বাচ্চার কান্নার শব্দ পেয়ে রাইসা রিয়াদকে পড়তে বলে ও ঘরে চলে গেলো।

রিয়াদ সমস্ত ভাবনাগুলোকে মনের গহীনে লুকিয়ে দিনপঞ্জিটা পড়তে শুরু করলো।

_____

শুরুটা কিভাবে করবো জানি না। তবে এখানে কিছু লেখার পূর্বে আমি একটা কথা বলতে চাই,

”হয়তো যাকে ভালোবাসা যায় তাকে ভরসা করে সবকিছু শেয়ার করা যায় না। নয়তো আমি যাকে ভালোবাসা ভেবেছিলাম সেটা ভালোবাসা ছিলোই না”।

আজ আমি যা লিখবো সবটাই তার জন্য যাকে আমি আমার থেকে বেশি ভরসা করি। যার সাথে কখনো কোন কথা শেয়ার করতে, আমার মধ্যে কোন দ্বিধা কাজ করেনি। আমার এই লেখাগুলো তার জন্য। সে হলো আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু রিয়াদ।

আমার মন বলছে, কোন একদিন রিয়াদ আমার খোঁজে এখানে আসবে। সেদিন যদি আমি না থাকি, তাই মনের সব কথা এখানে লিখে রাখছি। জীবনের সমাপ্তি হয়তো খুব কাছে, তাই সমাপ্তির পূর্বের নিজের মনের গোপন কিছু কথা বলতে চাই।

রিয়াদ। নামটা মনে পড়লেই প্রথমে আমার স্মৃতিতে যে কথাটি ভেঁসে ওঠে সেটা হলো, ”এ আমার প্রথম আবেগ। যার চোখে নিজেকে দেখার লোভটা বড্ড পুড়িয়েছে আমায়”।

কথাটি বুকে বাঁধলো তোর। আমি জানি রিয়াদ, হয়তো এই কথাটি শুনে খুশি হসনি তুই। তবুও আজ বলছি, ”হ্যাঁ তুই আমার প্রথম আবেগ, প্রথম অনুভূতি”। যেই অনুভূতিকে আমি ছোট মস্তিষ্কের ভুলচিন্তা বলে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ কেন জানি না মনে হচ্ছে, ঐ ভুল চিন্তাটাই আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সত্য ছিলো।

আজ জানতে খুব ইচ্ছে করছে রিয়াদ, কেন আমায় ভালোবাসলি না? কেন তোর অনুভূতি অন্য কারো জন্য জন্মালো? তোর অনুভূতিটা অন্যজনের জন্য ছিলো বলেই, আমি জীবনে ভুল মানুষকে বেঁছে নিতে বাধ্য হয়েছি।

হ্যাঁ তুই ঠিকই শুনেছিস, তোর জন্য আমার জীবনটা ভুলময় হয়ে গেছে।

তখন বয়ঃসন্ধির সূচনা কাল ছিলো। অষ্টম শ্রেনিতে বসেই মনের মধ্যে আবেগ, অনুভূতির জন্ম হয়েছিলো। সে বছরের প্রতিটা মূহুর্ত আমি তোকে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করতাম। যখন মাঠের মধ্যে আমি আর স্বপ্না বসে গল্প করতাম, ঠিক তখনি তোর আবেগি চোখ দেখে নিজেকে স্বপ্নের দুনিয়ায় ভাঁসিয়ে নিয়ে আসতাম। আমার সেই স্বপ্ন ভেঙে গেছিলো কয়েকদিনের মধ্যেই যখন স্বপ্না বললো,” দেখ রিয়াদ কিভাবে আমায় ভালোবাসার কথা বলছে”?

আমি চমকে স্বপ্নার দিকে তাকিয়ে বললাম,”তোকে ভালোবাসার কথা বলছে মানে”?

স্বপ্না লাজুক হেঁসে বললো,”তুই তো জানিস না, আসলে আমি আর রিয়াদ একে-অপরকে খুব ভালোবাসি। দেখিস না রোজ ও কিভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে? ক্লাসের ফাঁকেও তাকিয়ে থাকে। শুধু তাই নয় কাল ও আমার বইয়ের ভাঁজে একটা কাঠগোলাপ ও রেখেছিলো”।

স্বপ্নার লাজুক হাসি, ওর বলা প্রতিটা কথাই নদীর বুকে ভাঙ্গনের সৃষ্টি করেছেন। সেদিন সারারাত নিরবে খুব কান্না করছিলাম।

নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দিয়ে কিছুটা আসা নিয়ে সেদিন তোর কাছে গিয়েছিলাম রিয়াদ। সেদিন যখন তোকে জিজ্ঞেস করলাম,”তুই আমাকে কি ভাবিস রিয়াদ”?

”কি ভাবি মানে”?

”বন্ধু নাকি বিশেষ কেউ”?

তুই সেদিন মুচকি হেঁসে বলেছিলি,”বন্ধু। শুধু বন্ধু নয়, বিশেষ বন্ধু। যার জন্য আমি সবকিছু করতে পারি”।

হঠাৎ আনমনে জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলাম,”আমাকে আর স্বপ্নাকে কি একই ভাবিস নাকি ভিন্ন কিছু”?

সেদিন তোর বলা জবাবটা বুঝিয়ে দিয়েছিলো, আমি তোর প্রিয় বন্ধু হতে পারি কিন্তু ভালোবাসা না। তোর ভালোবাসাটা হলো স্বপ্না। সেদিন রিয়াদ বলেছিলো,” উহু এক নয়। তুই আর স্বপ্না আমার কাছে আলাদা। একজন বিশেষ কেউ অন্যজন বন্ধু”।

সেদিন তোর উত্তরটা বুঝিয়ে দিয়েছিলো, আমি তোর বন্ধু। যেটা তুই আগেই বলেছিলি। তখন বিশেষ কেউটা কে তা বুঝতে অসুবিধা হলো না আমার। সেদিনের পর থেকে অনুভূতিটাকে আর জাগিয়ে তুলিনি।

মনকে বুঝিয়েছিলাম, ওটা ভুল ভাবনা। হয়তো ভালোলাগা, এটা ভালোবাসা নয়। তারপর হঠাৎ জয়ের সাথে কেমন করে জানো ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠলো! তুই আর স্বপ্না প্রেম করছিস, হয়তো সেই ভাবনা থেকেই আমার অবুঝ মন জয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়তে শুরু করলো। জয়ের জন্যও ভালোলাগার সৃষ্টি হলো। সেই ভালোলাগাকে ভালোবাসার রুপ দিয়ে তোর প্রতি জমা অনুভূতিটাকে মেরে ফেললাম।

তবুও মনের কোনে আসা নিয়ে সেদিন তোকে পরিক্ষা করতে চাইলাম। যখন আমার কান্না দেখে তুই বললি পরেরবার থেকে জয় প্রথম হবে। তখন একবুক আসা নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম,” আমার কষ্টের জন্য তুই জয়কে প্রথম হিসাবে গড়ে তুলতে কেন চাচ্ছিস”?

তখন তুই কি বলেছিলি মনে আছে রিয়াদ? বলেছিলি,”কারন তুই আমার প্রিয় বন্ধু”।

তারপর থেকে কেন জানিনা মন থেকেই মেনে নিয়েছিলাম, তুই আমার ভালোলাগা। ভালোবাসাটা জয়কেই করে নিলাম। জয়ের প্রতি জন্ম নেওয়া অনুভূতিটাকে ভালোবাসা বলে চালিয়ে দিলাম।

ভালোবাসায় দ্বিতীয়বার অপূর্নতা চাইনি বলেই জয়ের সাথে একটা সুন্দর সংসারের স্বপ্ন দেখেছিলাম। স্বপ্ন সত্যিও হলো। তোর বন্ধুত্বের প্রতিদানে আমাদের বিয়েটা হলো।

বিয়ের পর৷ বধু বেশে বসে ছিলাম বাসর ঘরে। বাসর ঘর নিয়ে প্রত্যেকটা মেয়েরি একটা সাজানো স্বপ্ন থাকে। প্রিয় মানুষের হাত ধরে সারাজীবন পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি নিবো। এরকম একটা স্বপ্ন নিয়েই আমি অপেক্ষার প্রহর গুনেছিলাম। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে জয় আমার কাছে এসেছিলো। সেদিন জয়ের হাত ধরে স্বপ্নটাও সত্যি হয়েছিলো। জয় বাসর ঘরে ডুকে খুব মায়াভরা কন্ঠে বললো,” প্রেয়সী”?

আমি তখন স্বপ্নের দুনিয়া থেকেই জবাব দিয়েছিলাম,”হু”।

”ভালোবাসি”।

আমি মুখ তুলে জয়ের মুখশ্রীতে তাকালাম। জয় মুচকি হেঁসে পাশে বসে আমার হাতটা ধরলো। হাত ধরে বললো,”এই হাতটা আজ ধরলাম, আর কখনো ছাড়বো না”।

একটু থেমে পুনরায় বললো,”হাত ধরে সারাটি জনম কাটাতে চাই। সুখে দুঃখে সবসময় পাশে থাকতে চাই”।

আমি জয়ের মুখশ্রীতে তাকিয়েই রইলাম। জয় আবারো বললো,” প্রেয়সী থাকবে তো সারাজীবন পাশে”।

সেদিন আমার সত্যি স্বপ্নের মতো কেটে গেল।

তারপর দুটো বছর ভালোবাসায় পার হয়ে গেলো। দিনগুলো খুব ভালো চলছিলো। সবকিছুর মাঝে একটা শূন্যতা ছিলো। সেটা হলো রিয়াদ নামের বন্ধুটা। বিয়ের পর তোর সাথে আর যোগাযোগ হয়নি। আমার মন খারাপের গল্পগুলো সেদিনই জয়ের সাথে করে উঠতে পারিনি। মন খারাপ হলে প্রথম যার নামটা মাথায় আসতো সে হলো রিয়াদ। ভেবেছিলাম হয়তো স্বপ্নার সাথে দিনগুলো তোর ভালো কাটছে। চিঠি লিখে দেওয়ার আবদার, মেলা নিয়ে যাওয়ার বায়না করার মানুষটা এই নদী ছিলো না বলেই হয়তো ভালো কাটছে তোর দিন। সেদিন মনে হয়েছিলো, তোর আর স্বপ্নার কথা জানার পরও তোকে বিরক্ত করাটা আমার ভুল ছিলো। কি করবো বল? বড্ড বোকা ছিলাম যে।

যাই হোক। দু’বছর পর হঠাৎ একদিন মন খারাপের গল্প নিয়ে জয় সামনে এসে দাঁড়ালো। জয় বিষন্ন মন নিয়ে বললো,” প্রেয়সী আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে”।

_”কি হয়েছে? তুমি এভাবে বলছো কেন”?

_”আমায় ছেড়ে যাবা না তো প্রেয়সী। বলো না৷ সত্যিটা জানার পর চলে যাবা না তো”?

_”কি হয়েছে আমায় এটা বলো না”?

সেদিন জয় যা বললো তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। জয় বললো,”আমি কোনদিন বাবা হতে পারবো না প্রেয়সী”।

সেদিন চমকালেও ভেঙে পড়িনি। ভেঙে পড়ার পূর্ব মূহুর্তেই তোর বলা একটা কথা মাথায় কড়া নাড়লো,”সবসময় মাথা ঠান্ডা রেখে চলবি। কোন কিছুতে উত্তেজিত হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিস না”।

সেদিন জয়ের কথা আমি মানিনি। শহরে এসে ডাক্তার দেখাতে বলেছিলাম। ডাক্তার দেখানোর পর সেখানে পরিস্কার লেখা ছিলো, ও কোনদিন বাবা হতে পারবে না।

ভালো যখন বেসেছিলাম তখন মনে করেছিলাম ভালোবাসা দিয়েই সব অপূর্ণতা ভুলে থাকবো। সন্তানহীন হয়েই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম।

তখন সংসার জীবনের চার বছর চলে। হঠাৎ একটা তথ্য সবকিছু বদলে দিলো। কিছুদিন যাবত মাথা ঘুরে, বমি পায়। এসব দেখে মনের মধ্যে সন্দেহ জাগলো। তাইতো নাড়ি দেখে গর্ভবতী কিনা বলতে পারতো যে দাদীমা তাকে ডাক পাঠালাম রিতুকে দিয়ে। সে এসে নিশ্চিত করলো আমি গর্ভবতী।

আমি ভেবেছিলাম, হয়তো চমক ঘটেছে। আমার শূন্য কোল ভরিয়ে দিতে আমার সন্তান আসছে।

হঠাৎ ধমকা হাওয়ায় সব বদলে গেলো।

পর্ব নয়

ধমকা হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে গেলো সবকিছু। জয় মেনে নিতে পারলো না এই সন্তানটা তার। সুখের সংসারে শুরু হলো অশান্তি, ঝগড়া, বিবাদ। শত চেষ্টা করেও আমি বুঝাতে পারলাম না, হয়তো রিপোর্টে ভুল ছিলো। জয় মানতে নারাজ।

মাঝে মাঝে মনে হতো নিজের অজান্তে ভুল করে ফেলেছি নাকি! নিজেকে দোষারোপ করতে দু’বার ভাবিনি।

হঠাৎ একদিন জয় বললো, ”আমি বিচ্ছেদ চাইছি”?

”মানে”?

”তালাক”।

সেদিন আমার মনের মধ্যে কি চলছিলো তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। তবুও আমি জোর দিয়ে বললাম, আমি বিচ্ছেদ চাই না। জয় শত চেষ্টা করেও আমাকে রাজি করাতে পারলো না। আমি নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম।

তারপর যে কি হলো! জীবনের চরম সত্যের মুখোমুখি হ’তে হলো আমাকে। রিতুর মাধ্যমে জানলাম জয় স্বপ্নার সাথে সম্পর্কে লিপ্ত। তাদের সম্পর্কটা পরিনতি চায়, তাই আমাকে তালাক দিতে চাচ্ছে জয়। প্রথমে রিতুর কথা বিশ্বাস হয়নি, তারপর রিতু আমার হাতে স্বপ্নার দেওয়া জয়কে লেখা একটা চিঠি আমার হাতে তুলে দিলো। যেখানে ওদের সম্পর্কের তিনটা বছরের সুন্দর মূহুর্তের বর্ননা দেওয়া ছিলো।

বলার মতো ভাষা খুঁজে পাইনি। সেদিন তোর সাক্ষাৎ খুব করে চাইছিলাম রিয়াদ। রিতুকে দিয়ে তোর খোঁজ নিতে পাঠালাম। কিন্তু তুই ছিলি না। তোর খোঁজ না পেয়ে, কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না।

রিতু আমাকে খুব ভালোবাসে, তাই আমার জন্য অনেককিছু করেছে।

সেদিন রাতে হঠাৎ করে স্বপ্নার আগমন ঘটে আমাদের বাড়িতে। স্বপ্নার আগমনই আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলো, আমার সংসার জীবনটা বোধহয় এখানেই শেষ। কিন্তু সেদিন রাতে আমি যা শুনলাম তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমার শাশুড়ী আম্মা সব জানতেন, কিন্তু তিনি নিশ্চুপ ছিলেন। হয়তো কর্মঠ সন্তানের সিদ্ধান্ত বাঁধা দেওয়ার ক্ষমতা তার ছিলো না। তবে রিতু চুপ ছিলো না, সে সাহায্য করেছিলো। রিতুর জন্যই সেদিন জয় এবং স্বপ্নার কথোপকথন আমার কান অব্দি এসেছিলো।

সেদিন রাতে জয় এবং স্বপ্না বলছিলো,

_”তুমি আমাকে সত্যি ভালোবাসো জয়”?

_”এটা কোন ধরনের কথা স্বপ্না। তুমি খুব ভালোভাবে জানো, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি”।

_”তাহলে তোমার জীবনে এখনো নদী কেন আছে”?

_”ও তালাক দিতে চাচ্ছে না, কিভাবে নিবো”?

_”আমি এসব কথা এখন শুনতে চাচ্ছি না। এসব পুরনো কথা। নতুন কি সিদ্ধান্ত নিয়েছো তাই বলো”?

_”নতুন সিদ্ধান্ত মানে”?

_”মেরে ফেলো নদীকে”।

স্বপ্নার কথা জয় কিছুটা অবাক হলেও কিছু বললো না। শুধু আস্তে করে বললো,

_”নিজের গায়ে খুনের কলঙ্ক লাগানোটা কি ঠিক হবে”?

_”আমাকে পেতে হলে তোমাকে নদীকে জীবন থেকে সরাতে হবে। তাই নদীকে মরতে হবে। তবে তুমি যদি আমাকে না চাও তবে…..”।

_”এসব বলো না, আমি সত্যি তোমাকে চাই। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি স্বপ্না। তোমার জন্য আমি নদীকে জীবন থেকে সরাতে রাজি আছি। নদীকে সরাতে যদি ওকে মেরে ফেলতে হয় তবে আমি তাই করবো”।

_”তাহলে যা করার আজকে করবে”।

পরের কথাগুলো শোনার সাহস আর হলো না। তাই চলে গেলাম। নিজের সন্তানের কথা ভেবে রিতুর কথামতো সেদিন রাতে বাড়ি ছাড়লাম। নিজের বাড়িতে যাওয়ার সাহস হয়নি, বিবাহিত সন্তানের বোঝা বোধহয় কোন বাবা, মার জন্যই সুখের নয়, তাই বাবা, মাকে নিজের দুঃখের কথা ন জানিয়েই চলে গেলাম। সেই সাথে আরো একটি কারন ছিলো, জয় আমাকে আর কখনো যাতে খুঁজে না পায় তাই শহরে চলে এসেছিলাম। শহরে রাইসাই একমাত্র পরিচিত ছিলো বলে, ওর কাছে এলাম।

রিয়াদ তোকে আমি কখনো অবিশ্বাস করতে চাইনি, এখনো চাই না। তবে জীবনের শেষ মূহুর্তের আগে অন্তত একবার জানতে চাই, কেন ভালোবাসলি না আমায়? ভালো যখন স্বপ্নাকেই বেসেছিলি তাহলে ততটা ভালোবাসা দিলি না কেন যতটা ভালোবাসলে সে তোকে ছেড়ে যেতে না পারে?

আমি আজও বিশ্বাস করি, তোর ভালোবাসায় কোন খাদ ছিলো না। হয়তো স্বপ্নার ভালোবাসায় খাদ ছিলো, তাই ও তোকে ছেড়ে জয়কে ধরেছিলো। কিন্তু ধরলোই যখন তখন জয়কে কেন? কেন আমার সন্তানের ভাগ্য থেকে বাবার পরিচয়টা কেড়ে নিলো?

পরিশেষে,

আমার জীবনে জয়ের সাথে কাটানো মূহুর্তগুলো যতটা না মনে পড়ে, তারচেয়ে তোর সাথে কাটানো মূহুর্তগুলো বেশি মনে পড়ে। এটাকে কি বলে রিয়াদ?

দিনপঞ্জিটা ভালোভাবে দেখলো রিয়াদ। এতটুকু লেখা ছাড়া আর কিছু আছে কিনা। শেষ পৃষ্ঠায় দুই লাইনে একটু লেখা ছিলো,

”তুই বন্ধু সদূর আকাশ, আমি ঢেউময় নীর।

চাইলেও পারবো না ছু’তে

আমি বন্ধুর মন”।

রিয়াদ অনুভব করলো তার চোখে অশ্রু। দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সমস্ত দিনপঞ্জি পড়ে রিয়াদের মন বারবার বলতে চাচ্ছে,”আমি তোকে খুব ভালোবাসি নদী। খুব খুব খুব ভালোবাসি”।

এতক্ষণে বাচ্চাকে সামলে রাইসা রিয়াদের কাছে এলো। রাইসাকে দেখেই রিয়াদ বললো,”নদী কোথায়”?

রাইসা আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,”ভালোবাসো নদীকে”?

রিয়াদ নিজেকে সামলে বললো,”যা বলার তাকেই বলবো”।

_”সময়ের কাজ অসময়ে করলে ভুল হয়ে যায়”।

_”ভুলটা শুধরে নিবো”।

_”উপায় নেই”।

_”কেন”?

_”নদী তো নেই”।

রিয়াদ চমকালেও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে জিজ্ঞেস করলো, ”নেই মানে”?

_”নদী তার ঢেউয়ের মাঝে হারিয়ে গেছে। সে হারিয়ে গিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, সে কারো নয়”।

_”আমি কিছু বুঝতে পারছি না”।

রাইসা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

_”সেদিন বাড়িতে নদী একা ছিলো। গর্ভাবস্থায় তখন প্রায় নয় মাস চলে। মন থেকে ওকে একা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে না করলেও, উপায় ছিলো না। সেদিন আমাকে আর রবিনকে(স্বামী) একটা কাজে যেতেই হতো। আমি অবশ্য যথেষ্ট তাড়াতাড়ি ফিরে আসার চেষ্টা করেছি। দু’ঘন্টার মধ্যে বাড়ি ফিরে এসেও লাভ হলো না। যা ক্ষতি হওয়ার হয়েই গেলো। দরজা খোলা দেখেই মনের মধ্যে ভয় জন্ম নিয়েছিলো, ভয়কে সত্যি করে নদী রক্তাক্ত অবস্থায় সেদিন পড়ে ছিলো। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ায় বাচ্ছাটা বেঁচে গিয়েছিলো। কিন্তু নদী বাঁচেনি। আমি জানি না সেদিন নদীর সাথে কি হয়েছিলো, তবে ওর গলায় দাগ দেখে এটা বুঝেছিলাম কেউ ওর গলা চেপে ধরেছিলো৷ নদী সেদিন চলে গিয়েছিলো ঠিক, তবে নিঃসন্তান এই রাইসার বুকে একটা সুন্দর মেয়ে তুলে দিয়ে গেলো”।

শেষ বাক্যটি রাইসা খুব তৃপ্তির সাথে বলছিলো। রিয়াদের পৃথিবী সেখানেই থমকে গেলো। রিয়াদ সেখানেই বসে পড়লো। রাইসা অন্যঘরে চলে গেলো। কিছুক্ষন পর একটা ফুটফুটে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে রিয়াদের সামনে এলো। রিয়াদের চোখ দিয়ে অশ্রুর বৃষ্টি পড়ছিলো। রিয়াদ হাউমাউ করে কাঁদতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। ভিতরে সব কান্নাগুলো ধলা পাকিয়ে গেছে কেমন! রাইসা বাচ্চাটাকে রিয়াদের সামনে ধরে বললো, ”নদীর মেয়ে”।

রিয়াদ চোখ তুলে বাচ্চাটার দিকে তাকালো। পরম স্নেহে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বাচ্চাটির মাথায় রাখলো। মুখশ্রী সামনে এগিয়ে এনে চুমু খেলো। রাইসা পুনরায় বললো,”ওর নাম রিয়ানা৷ নদী তোমার সাথে মিল করে এই নামটি রাখতে বলেছিলো”।

রিয়াদ বললো,”ওকে আমার কোলে দিবেন”?

_”হ্যাঁ”।

রিয়াদ রিয়ানাকে কোলে নিয়ে অনেকগুলো চুমু খেলো। রিয়ানার মুখশ্রীতে তাকিয়ে মনেমনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

”ভালোবাসা দুই পক্ষই ছিল।

কিন্তু তা অচেনা রয়ে গেলো”।

রিয়াদ জয় এবং স্বপ্নার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। জয় বিরক্ত নিয়ে বললো,

_”তুই বারবার আমাদের বিরক্ত করতে কেন আসছিস”?

_”নদীকে মেরে ফেললি কেন”?

রিয়াদের কঠিন গলায় বলা কথাটি জয় এবং স্বপ্নাকে অবাক করে দিলো। জয়ের আম্মা কিছু বলতে নিলে রিয়াদ তার সামনে হাতজোড় করে বললো,

_”কাকী মা আজ আপনি কিছু বলবেন না দয়া করে। আমি আজ জয় এবং স্বপ্নার সাথে কথা বলতে চাই। আসা করি আপনিও অনেককিছু জানেন, হয়তো বলতে চাইবেন না। তাই বলছি বলতে না পারেন, অন্ততপক্ষে আমাকে বাঁধা দিয়েন না”।

রিতু নিজের আম্মাকে নিয়ে অন্যঘরে চলে গেলো। জয়ের আম্মাও নিরবে চলে গেলেন। তিনি আস্থা রাখছেন জয় রিয়াদকে বুঝিয়ে পাঠিয়ে দেবে।

রিয়াদ জয়ের মুখশ্রীতে তাকিয়ে বললো,

_”কেন মারলি? ভালোবাসতি না? ভালোবাসার সংসারে কেন তৃতীয় ব্যক্তির আগমন ঘটালি”?

জয় নিশ্চুপ। রিয়াদ স্বপ্নার দিকে প্রশ্ন ছুড়লো,

_”তুই না আমাকে ভালোবাসতি। তাহলে জয়কে কিভাবে ভালোবাসলি? তুই না আমার জন্য পাগল ছিলি, তাহলে জয়কে বিয়ে কিভাবে করলি”?

জয় চমকে স্বপ্নার মুখশ্রীতে তাকালো। বিষ্ময় নিয়েই বললো,

_”তুমি রিয়াদকে ভালোবাসতে”?

স্বপ্না স্বাভাবিকভাবে বললো,

_”এখনো বাসি”।

জয় এবং রিয়াদ দু’জনেই চমকে উঠলো। স্বপ্না পুনরায় বললো,

_”প্রেমের যুদ্ধে হেরে গিয়েও জিতে গিয়েছি আমি। তাই আমি যা করেছি তার জন্য কোন আফসোস নেই। কখনো হবেও না”।

_”এখনো আমাকে ভালোবাসলে জয় এবং নদীর সম্পর্কে কেন বাঁধা হয়ে দাঁড়ালি”?

_”কারন নদীর ভালোবাসা তোকে আমায় হতে দেয়নি তাই”।

জয় আস্তে করে বললো,

_”তুমি আমাকে ভালোবাসো না”?

_”না। আমি শুধু নদীর কান্না দেখতে চেয়েছিলাম। নদীর জন্য আমি যেভাবে কেঁদেছি, ঠিক সেভাবে নদীকে কাঁদাতে চেয়েছি”।

_”তিন বছরের প্রেম, দুই বছরের সংসার সব মিথ্যে”।

_”হ্যাঁ মিথ্যে”।

জয় থ মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। স্বপ্না রিয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো,

_”মনে পড়ে সেদিনের কথা, যেদিন আমি তোকে বলেছিলাম নদী তো ওর সংসারে সুখী আছে, চল আমরা দু’জন নতুন করে শুরু করি। তখন কি বলেছিলি তুই? বলেছিলি নদী তোর জীবন থাকুক কিংবা না থাকুক তুই তাকেই ভালোবাসিস। তারপর তুই হঠাৎ হারিয়ে গেলি। তোকে জীবনে নাই বা পেতাম, অন্তত চোখের দেখা দেখতে তো পেতাম। কিন্তু তাও হলো না। কার জন্য হলো না? সেই তো নদীর জন্য। তাই আমি ঠিক করেছিলাম, নদীকেও সুখী হতে দেবো না। তাই হলো। জয়কে নিজের ভালোবাসায় বেঁধে নদীকে কান্নার সাগরে ভাঁসিয়ে দিলাম”।

স্বপ্নার চোখে অশ্রু। হয়তো ভালোবাসা না পাওয়া অশ্রু। কিন্তু তাই বলে সে যা করেছে সেটা কি ঠিক?

তখনি স্বপ্না বলে উঠলো,

_” আমি হয়তো ভুল করেছি। তবে জয় কিন্তু নদীকে সত্যি ভালোবাসতো না। যদি সত্যি ভালোবাসতো তবে সে আমায় আসক্ত হতো না। নদীর মাধ্যমে তোর থেকে সব সুযোগ, সুবিধা নেওয়াটাই ছিলো জয়ের উদ্দেশ্য।

এখন তুই বলতে পারিস, নদীকে কাঁদিয়ে আমি কি সুখী হয়েছি? না হয়নি। এখন বলবি তাহলে এসব কেন করলাম? আসলে কোন মানুষি কষ্টে থাকতে চায় না। সবাই চায় কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে। কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার আসায় তারা সুখ খুঁজতে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। আমিও তেমন, আমি ভেবেছিলাম নদীর কষ্টে হয়তো আমি শান্তি পাবো।

জয় যখন নদীকে বলেছিলো ও বাবা হতে পারবে না। আমি ভেবেছিলাম নদী কষ্ট দুঃখে জয়কে ছেড়ে দিবে। কিন্তু দেয়নি। জয় যখন তালাক চাইলো তখনো দেয়নি। তাই শেষমেশ”।

স্বপ্না থেমে গেলো। রিয়াদ বললো,

_”তাই শেষমেষ তাকে মেরে ফেললি”?

_”উহু। আমি কিন্তু মারিনি, মেরেছে জয়। নদী যাতে সন্তানকে ঢাল করে ওর জীবনে ফিরে না আসে তাই মেরে ফেলেছিলো”।

স্বপ্না একটু থেমে পুনরায় বললো,

_”জানিস জয় নদীকে কিভাবে মেরেছে? নদী যখন দরজা খুললো, ঠিক তখন জয় ওর পেটে লাথি মারলো। তারপর বেশ অনেকক্ষণ গলা চেঁপে ধরলো। জানিস নদীর চোখে তখন কতটা বিষ্ময় ছিলো। যার সন্তান ওর গর্ভে সেই মানুষটা ওকে যন্ত্রণা দিয়ে মারছিলো। ওর নিঃশ্বাস বন্ধ করার চেষ্টা করছিলো। তখন নদীর চোখে যে অশ্রুটা ছিলো না, ওটা দেখে আমার হালকা কষ্ট হচ্ছিলো। হ্যাঁ রে শত হোক বন্ধু তো। তার এমন করুন মৃত্যু…….”।

স্বপ্না ঘোরের মধ্যে হয়তো সব বলে দিচ্ছিলো কিন্তু অন্যদিকে রিয়াদের রিয়েকশন সে বুঝতে পারেনি। রিয়াদ তার ভালোবাসার করুন পরিনতির কথা স্মরণ করে যে কান্ড ঘটালো, তার জন্য ওখানে থাকা কেউ প্রস্তুত ছিলো না।

পর্ব দশ

স্বপ্না বলেছিল,

_”জয় এক নারীতে আসক্ত হ’য়ে কাটাতে পারিনি, তাই তো দ্বিতীয় নারীর প্রতি আসক্ত হয়েছে। তুই যদি ভাবিস জয় আমাকে ভালোবাসে তবে ভুল, জয়ের মতো কিছু ছেলেরা শুধু নতুনত্বই খুঁজে। নদীর সাথে সব শেষ তখনি সে নতুন মোহে পড়েছে। যার সুযোগ নিয়েছে আমার প্রতিহিংসা। তুইতো জানিস না জয় নদীকে ঠিক কিভাবে মেরেছে! এই যে(পেটে হাত দিয়ে) এখানে নদীর বাচ্চাটা ছিলো ঠিক সেখানে লাথি মেরেছিলো৷ আমি তখন কষ্ট পেয়েছিলাম জানিস রিয়াদ, কিন্তু আমার হিংসা, ঘৃনা, কষ্টের মধ্যে নদীর কষ্টটা আমাকে ছু’তে পারেনি। নদীর শ্বাসরোদ করার সময়ো আমার ভালো লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রনাটা কমে যাচ্ছে। আমার……”।

স্বপ্না ঘোরের মধ্যে রিয়াদকে এসব বলছিলো। স্বপ্নার ঘোর বুঝতে পারেনি তার কথাগুলো রিয়াদের মধ্যে থাকা পিশাচ শক্তিকে জাগিয়ে দিবে। খাঁটের পাশে দা, বটি রাখা ছিলো। রিয়াদ দা টা হা’তে নিয়েই স্বপ্নার গলায় চালিয়ে দিলো।

কয়েক মূহুর্তের জন্য সব নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। জয় ভয়মিশ্রিত কন্ঠে চিৎকার দিলো,

_”স্বপ্না”।

জয়ের চিৎকারে অন্যঘর থেকে রিতু এবং আম্মা চলে এলো। তাদের আসতে দেড়ি হয়ে গেছিলো, তার পূর্বেই রিয়াদ দ্বিতীয় আঘাতটা জয়কে করলো। কিন্তু জয়ের গলায় নয়, আঘাতটা তার বুকে করলো। একবার নয় তিনবার আঘাত করলো। তারপর বললো,

_”ভালোবাসা পেয়ে তাকে চিনলি না জয়। তুই তো হেরে যাওয়া মানুষ। জয় নামটা তোর সাথে যায় না”।

একটু থেমে পুনরায় বললো,

_”ভালোবেসে নদীকে প্রেয়সী ডাকতি তাই না জয়। অথচ প্রেয়সী মানেটাই জানিস না”।

কথাটি বলে আরো একবার আঘাত করলো। এরমধ্যে জয়ের আম্মা চলে এলো এবং চিৎকার দিলো।

রিতু গিয়ে রিয়াদকে ধরলো। কান্নারত কন্ঠে বললো,

_”আমার ভাইয়াকে ছেড়ে দেও”।

রিয়াদ দা ফেলে দিয়ে বসে পড়লো।

গ্রামের লোকজনের সাহায্যে জয় এবং স্বপ্নাকে হাসপাতালে নেওয়া হলো। কিন্তু বাঁচানো সম্ভব হয়নি। কথায় বলে, ”প্রতিহিংসার আঘাত ততটা মজবুত যতটা মজবুত হলে চোখের লাভায় একজন মানুষকে বিনাশ করা সম্ভব”।

________

পরিশেষে এই অন্ধকারের জেলে পঁচিশ বছর কাটাচ্ছি। আমার আপন বলতে কেউ ছিলো না বলে, আমার পক্ষে কোন উকিল দাঁড়ায়নি। তাছাড়া আমারো কখনো ইচ্ছে হয়নি এখান থেকে বের হওয়ার। বেশ তো আছি আমার নিরব ভালোবাসার স্মৃতি নিয়ে।

রিয়ানা এতক্ষন খুব মনোযোগ দিয়ে পুরোটা শুনছিলো। হঠাৎ অনুভব হলো তার চোখে অশ্রু। গড়িয়ে পড়া অশ্রুর দিকে দৃষ্টি রেখে রিয়ানা বললো,” আপনি যা বললেন তার সত্যটা কতটুকু”?

রিয়াদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”রাইসা আপুর কাছে জিজ্ঞেস করলেই তো ঘটনাটা জানতে পারতে”।

_”তার ঠিকানা”?

_”ঠিকানা মানে, তোমার তো তার কাছেই বড় হওয়ার কথা”।

_”ভাগ্যটা স্বায় দেয়নি, তাই তো অনাথ আশ্রমে বড় হওয়া”।

রিয়ানা পুনরায় বললো, ”অনেক কষ্ট করে আমি আপনার অব্দি এসেছি। আমি আপনার কথার সত্যতা বিচার করে জানাবো, কে আমার বাবা”?

রিয়ানা আর দাঁড়ালো না চলে গেলো।

রিয়ানা রাইসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। রাইসা মাথানত করে বললো,”তুমি যা শুনেছো সবি সত্যি। তোমার আমার কাছেই বড় হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু স্বার্থপর এই দুনিয়ায় স্বার্থ ছাড়া মানুষ নেই। তাই আমিও স্বার্থপর হলাম।

তুমি যখন আমার জীবনে এসেছিলে তখন আমি নিঃসন্তান ছিলাম। তাই তোমাকে আপন করে নিয়েছিলাম। তবে যখন আমার নিজের সন্তান হলো, তখন আমার মধ্যে স্বার্থপর একটা মানুষের জন্ম হয়। যার কাছে মনে হতো, তোমাকে বড় করলে আমার সন্তানের ভালোবাসায় ভাগ বসে যাবে। আমার সন্তান ততটা ভালোবাসা পাবে না, যতটা তার প্রাপ্য”।

রিয়ানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলো।

পুনরায় রিয়াদের সামনে আসলো রিয়ানা। প্রথমে রিয়ানা জিজ্ঞেস করলো,”কেমন আছেন”?

_”তোমাকে দেখে বেশ ভালো হয়ে গেলাম”।

_”আমাকে দেখে ভালো হয়ে গেলেন, কেন”?

_”কারণটা তোমার জানা”।

_”কারন আমি আপনার নদীর মেয়ে তাই তো”?

_”হ্যাঁ। আমার কাছে তুমি আমারি সন্তান”।

_”তাহলে এই সন্তানের কথা ভেবে, এই সন্তানকে নিয়ে একটা সুন্দর জীবন কি গড়ে তুলতে পারতেন না আপনি”?

_”মানে”?

_”সেদিন কি পারতেন না সবকিছুকে পিছনে ফেলে বাচ্চা রিয়ানার হাত ধরতে? পারতেন কিন্তু ধরেননি৷ যদি ধরতেন তবে আজ আমাকে অনাথ আশ্রমে নয় বরং একটা পরিচয় নিয়ে, এই সমাজে বড় হয়ে ওঠা হইতো”।

একটু থেমে রিয়ানা পুনরায় বললো,

_”সেদিন বলছিল না, আমি জানো বিচার করি কে আমার বাবা? আজ বলছি আমার কোন বাবা নেই। জন্ম যে দিয়েছিলো সে তো বাবা নয়, আর আপনিও নন। আমি যেমন একা বড় হয়েছি, তেমনি একা। আমার কেউ নেই। কেউ না”।

রাগ, ক্ষোভ কিংবা কষ্ট যাই বলেন না কেন! নিজ নিজ স্থানে সবাই ঠিক।

পরিশেষে রিয়ানার সহযোগিতা পঁচিশ বছর পর কারাগার থেকে মুক্তি পেলো রিয়াদ।

মুক্তি পেয়ে রিয়াদ প্রথমে রিয়ানার সাথে সাক্ষাৎ করলো না। রিয়াদ অন্য একটা কাজ আছে বলে চলে গেলো।(ভালো লাগলে রিভিউ দেন জাতি, প্রথমবার রিভিউ চাচ্ছি)

রিয়ানাকে একটা স্থানে দেখা করতে বললো রিয়াদ। রিয়াদের কথামতো রিয়ানা যথা সময়ে ঠিক জায়গায় চলে এলো। হঠাৎ রিয়াদ সামনে এসে দাঁড়ালো রিয়ানার। রিয়ানা জিজ্ঞেস করলো,”এখানে ডাকলেন কেন”?

রিয়াদ কিছু না বলে পিছনে ঘোরার ইশারা করলো। রিয়ানা পিছনে ঘুরতেই দেখতে পেলো তার ভালোবাসা সৌরভ দাঁড়িয়ে আছে।

সৌরভ হাঁটু গেড়ে বসে রিয়ানার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,”বিয়ে করবে আমায়”?

_”তোমার পরিবার”?

_”তারা সবাই রাজি। আংকেল সবাইকে রাজি করিয়েছে। তাই আজ তোমার কাছে প্রস্তাব নিয়ে এলাম”।

_”যদি এখনো রাজি না হই”?

_”আংকেল একটি কথা বলেছেন,

প্রেয়সীর না কে কখনো না ধরবে না, সবসময় হ্যাঁ ধরবে। কারন এরা মেয়ে জাতি, মুখে এক মনে আর এক”।

_”কি”?

_”রাগে না সুইটি, কি চেয়েছি বলো! একটু যে ভালোবাসা। দেও না গো একটু ভালোবাসা”।

সৌরভ মুখশ্রী এমন করেছে যে রিয়ানা না হেঁসে পারলো না। রিয়ানা সৌরভকে জড়িয়ে ধরলো। পরক্ষনেই মনে হলো রিয়াদ আছে। পিছনে ঘুরে রিয়াদকে দেখতে পেলো না রিয়ানা। সামনে তাকিয়ে দেখে রিয়াদ চলে যাচ্ছে। রিয়ানা জোরে ‘বাবা’ বলে চিৎকার করলো। রিয়াদ পিছনে ঘুরে তাকালো। রিয়ানা পুনরায় ‘বাবা’ বলে ছুটে গেলো। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো।

জোৎস্না রাতে চাঁদের আলোয় পাশাপাশি বসে আছে বাবা, মেয়ে। নাই বা হোক রক্তের সম্পর্কের বাবা, মেয়ে। নিজেরা মানলেই হলো। বাবা, মেয়ে অনেক গল্প করছিলো। গল্পের এক পর্যায়ে রিয়ানা উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে হাতগুলো মেলে দিয়ে রিয়াদের উদ্দেশ্য বললো,

”আমি আকাশের হাজার তারার ভিড়ে ছড়িয়ে দেবো তোমার প্রেমের গল্প। তারারা বার্তাবাহক হয়ে পৌঁছে দেবে মায়ের কাছে, তোমার সেই #অচেনা_প্রেম গল্প”।

#বিষাদময় প্রেম ই বুক

(সমাপ্ত)

[কেমন লাগলো জনগন। শেষটা গোছানো হয়েছে তো। কোথাও কোন অভিযোগ থাকলে করতে পারেন। সমস্যা নাই। এতদিন পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ ]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are makes.

Back to top